সাইফুল ইসলাম, বাবুগঞ্জ (বরিশাল) : ব্যাপক সম্ভাবনাময় থাকা সত্ত্বেও বরিশালের বাবুগঞ্জের দূর্গাসাগর আজও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি। পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত এখানে পর্যাপ্ত পরিবেশ ও প্রাচীনকীর্তি শোভিত হয়ে পড়ে আছে। সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আর উদ্যোগহীনতার অভাবে এখানকার পর্যটনকে বিকশিত করা যাচ্ছেনা বলে স্থানীয়দের অভিমত।
বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশায় রাজবাড়ির সম্মূখে ইতিহাসখ্যাত দূর্গাসাগর দিঘী অবস্থিত। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার এ স্থানকে ট্যুরিষ্ট স্পট করার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কেউ তা একবারও ভেবে দেখেননি। দূর্গা সাগর দীঘি নিয়ে নানা জনের রয়েছে মত। তবে স্থানীয় সূত্রে ও এর ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তখনকার চন্দ্রদীপ রাজবংশের চতুর্দশ রাজা শিব নারায়ন এর অকাল মৃত্যু ঘটে। তখন তার রানী গর্ভবতী ছিলেন। শিব নারায়নের মৃত্যুর পর তার পুত্র পঞ্চদশ রাজা জয় নারায়ন রায় জন্মগ্রহন করেন। বিধবা রানী দূর্গাবতী বুদ্ধীমতি ও প্রজাবৎসল মহিলা ছিলেন। আঠার শতকের শেষভাগে নাটোরের রানী ভবানী ও চন্দ্রদীপের রানী দূর্গাবতী জমিদারী পরিচালনা করে বাংলার ইতিহাসে স্বরণীয় হয়ে আছেন। তিনি প্রজাদের মঙ্গলের জন্য অনেক পুকুর ও দীঘি খনন করে নিজ অর্থ দিয়ে। রানী দূর্গাবতী ১৮৭০ সালে রাজধানী মাধবপাশায় এই ”দূর্গাসাগর” দীঘি খনন করান। তিনি রাজ দরবারে আলোচনা করে রাজ বাড়ির পূর্ব পাশে দীঘি খননের পরিকল্পনা করেন। কথিত আছে, রানী একবারে যতদূর পাঁয়ে হোঁটে যেতে পারবেন দীঘি তত বড় হবে। রানী ৬১ কানি ভূমি পাঁয়ে হেঁটে অতিক্রম করেন। দীঘির পশ্চিমে শ্রীপুর , পূর্বে কলাডেমা , উত্তরে পাংশা এবং দক্ষিনে শোলনা ও ফুলতলা গ্রাম। চার গ্রামের মধ্যস্থানে এক শুভ দিনে হাজার হাজার লোক দীঘি খনন কাজ শুরু করেন। চন্দ্রদীপ রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম হতে প্রজারা দীঘি খননে অংশ নেয়। দীঘি খনন কাজ শেষ করতে প্রায় ছয় মাস সময় লাগে। সারাদিন কাজ করে শ্রমীকরা পশ্চিম পাশে একটি দীঘিতে মাটি খনন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র কোদাল ধৌত করত। এ দীঘির নাম দেয়া হয় কোদাল দীঘি। মাধবপাশা ও উজিরপুর এলাকার কর্মকাররা কোদাল তৈরি করত। শ্রমীকদের মজুরী করি (মুদ্রা বিশেষ) দিয়ে পরিশোধ করা হত। দীঘি খনন ও অর্চনার জন্য রানী রাজকোষ হতে তৎকালীন তিন লাখ টাকা ব্যায় করেন। চারপাশে পঞ্চাশ ফুট বিস্তৃত চারটি পাকা ঘাট নির্মান করেন। উৎসর্গ উপলক্ষে রাজধানী শ্রীপুরে হাজার হাজার পন্ডিত ব্রাম্মন কুলির উপস্থিত হন। এমন সময় রাজ পরিবারের এক বৃদ্ধার মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় শিশু জয় নারায়নের এক মাস অশৌচ পালন করতে হয়। বাধ্য হয়ে অতিথিদের এক মাস ধরে অভ্যর্থনা করতে হয়। অবশেষে নতুন পূর্ণ্যাহ তিথীতে উৎসর্গীত দীঘির উৎসর্গীত সমাপ্ত করেন। প্রায় একশ বছর পূর্বে দীঘিতে জঙ্গলে আবৃত হয়ে ভরে যায়। তখনকার জেলা বোর্ড তৎকালীন ১২০০ টাকা ব্যায় করে দীঘিটি পরিস্কার করেন। কিন্তু এর পর দ্বীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও এর কোন সংস্কার হয়নি। কালের চক্রাকারে চারদিকে গড়ে উঠেছে জনবসতি। ১৯৭৫ খ্রিষ্ঠাব্দে বাংলাদেশ সরকার দীঘিটি পূনঃ সংস্কার করেন। দীঘির নিচের অংশের দৈর্ঘ্য ১৯৫০ ফুট, প্রস্থ ১৭৫০ ফুট। এ ছাড়াও ১৯৭৯ সনে দূর্গা সাগর খনন কালে দুটি মূর্তি পাওয়া যায়। যা দের ইঞ্চি পুরু নিকশ কালো পাথরের উপর খদিত মরিচির মুর্তি। বর্তমানে মূর্তি দুটি ঢাকা জাতীয় জাদু ঘরে রক্ষিত আছে। জানাযায়, সপ্ত-অষ্টম শতাব্দিতে এ মূর্তি দুটি বানানো হয়। তখন এ অঞ্চলে বৈদ্যদের প্রভাব ছিল খুব বেশি। চর্যপদের আদি কবি মাৎসেন্দ্রনাথ এখানে বসবাস করতো। পরবর্তীতে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের ফলে বৈদ্যধর্মের উপর চরম উৎপীড়ন চালানো হয়। তখন মূর্তি দুটি রক্ষার জন্য উপসনা কারীরা দীঘিতে ফেলে দেয়। হাজারো ইতিহাসের উজ্জ্বল স্বাক্ষ্য বহনকারী দূর্গা সাগর আজ ধ্বংসের পথে। মহা প্রলংকারী ঘূর্নিঝড় সিডরের সময় এর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দীঘির উত্তর পাশের সানঘাটলা পরিত্যাক্ত অবস্থায় পরে রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রতিটি সরকারের আমলে দূর্গাসাগরের অতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য দেওয়া হয় প্রতিশ্রুতি। আর এ প্রতিশ্রুতি দেয়াটা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। দক্ষিনাঞ্চাল বাসীর এক মাত্র বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে দূর্গা সাগরের পুরনো শুনাম,ঐতিহ্য ও প্রকৃতির রুপ ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট মহলের কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। তা না হলে আর কখনো আসবেনা দূর-দূরান্ত থেকে অতিথি পাখি,যাবেনা কোন পর্যটক ও দর্শনার্থীরা । যার ফলে বাবুগঞ্জে এই ঐতিহ্যবাহী দূর্গা সাগর হারিয়ে ফেলবে তার পুরনো ঐতিহ্য। এত সব অব্যাস্থাপনা থাকা সত্তেও এখানে দৈনিক হাজারো পর্যটকের আগমন ঘটে। এখানে অধিকাংশ পর্যটক আসেন দূরদূরান্ত থেকে। সরকার যদি উদ্যোগ গ্রহন করে দূর্গাসাগরের উন্নয়নে কাজ করেন তাহলে এখানে দেশী বিদেশী সহ প্রচুর পর্যটনের আগমন ঘটবে। এতে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে এবং দূর্গা সাগর ন্থান পাবে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে।