জাকির হোসেন, ছাতক (সুনামগঞ্জ) : প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফরমালিনের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ায় ছাতকের ফল বাজারে পড়েছে চরমভাটা। বিভিন্ন হাট-বাজারে মৌসুমি ফলের প্রচুর আমদানী হলেও কেনা-বেচায় দেখা দিয়েছে মন্দাভাব। আকর্ষনীয়ভাবে ফলের পশরা সাজিয়ে রেখেও ক্রেতা সাধারণকে আকৃষ্ট করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলের মধ্যে ফরমালিন রয়েছে- এমন ভয়ে ক্রেতা সাধারণ ফল কিনতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফরমালিনের কুফল মানুষকে ক্রমেই সচেতন করে তোলায় ফল ব্যবসায় অনেকটা ধ্বস নেমে এসেছে। প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করার মতো কোন ব্যবস্থা না থাকায় সব ফলেই ফরমালিন রয়েছে এমন আশংকা কাজ করতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস আম, কাঠালের ভর মৌসুম। এ সময় সকল শ্রেনীর মানুষের ঘরে-ঘরে আম-কাঠালসহ মৌসুমি ফল খাবার ধুম পড়ে। অতিথি আপ্যায়ন ও স্বজনদের বাড়িতেও আম-কাঠাল পাঠানোর রেওয়াজ রয়েছে বাঙ্গালী পরিবারের মধ্যে। কিন্তু ফরমালিনের ভয়াবহতার কারনে অনেকেই আম-কাঠাল ক্রয় করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এরপরও জেনে-শুনেই পরিমানে কম হলেও ফরমালিনযুক্ত মৌসুমি ফল কিনছে ক্রেতারা। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যে ফরমালিনের উপর ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালালেও ফরমালিনের ভয়াবহতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছেনা। প্রতিদিনই ফরমালিনযুক্ত আম-কাঠাল বাজারে আসলেও প্রশাসনের নজরদারির অভাবে প্রকাশ্যেই এসব ফল বিক্রি হচ্ছে। ফরমালিনের ভয়াবহতা সম্পর্কে গণসচেতনতা ও এর কুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার-প্রচারনা চালানো ছাড়া তা রোধ করা সম্ভব নয় বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। আম-কাঠাল ছাড়াও লিচু, কালাজাম, আনারস, খেজুর, কলা, কমলা, মালটা, আপেল, শাক-সবজি, মাছসহ সব খাবারেই ফরমালিন দিয়ে টাটকা রাখা প্রবনতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। প্যাকেটজাত তরল দুধসহ পচনশীল সবধরনের খাবার টাটকা রাখতে এবং গোদামজাত মাছে ব্যবহৃত বরফেও ফরমালিন মেশানোর প্রবনতা সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। ফরমালিন নামক বিষ থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করতে আইনের বাস্তবায়নসহ প্রশাসনের কঠোর নজরদারির বিকল্প নেই বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন।

ফরমাল ডি হাইড্রেট নামক রাসায়নিক পদার্থের শতকরা ৪০ভাগ জলীয় দ্রবনের নাম ফরমালিন। এর রাসায়নিক সংকেত ঐঈঐঙ। ইহা একটি বর্ণহীন একধরনের ঝাঁঝাঁলো গন্ধ বিশিষ্ট রাসায়নিক যৌগমুলক। মৃতদেহ সতেজ রাখতে ফরমাল ডি হাইড্রেট ব্যবহার করা হয়। উন্নত বিশ্বে মানুষের দেহে সহনশীল পরিমানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে খাদ্য সামগ্রী দীর্ঘদিন সতেজ রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করে থাকে। ফরমালিন আর্শিবাদ হিসেবে আবি®কৃত হলেও এদেশে ফরমালিন নামটি অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। ফল মাছ বা খাদ্য সামগ্রীতে যারা নিয়মিত ফরমালিন ব্যবহার করে তাদের চর্ম রোগ, শ্বাসকষ্ট ও চোখের কর্নিয়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফল বিক্রেতা জানান, বিভিন্ন জাতের যেসকল আম বাজারে আসে এতে তারা কোন ফরমালিন ব্যবহার করেন না। বিভিন্ন ষ্টক ব্যবসায়ীরা গোদামেই ফরমালিন মেশিয়ে থাকেন। এখন গাছে থাকা অবস্থায়ই আমে ফরমালিন ছিটিয়ে দেয়া হয় বলে তিনি শুনেছেন। তবে বাগান থেকে কাঁচা কাঠাল ক্রয় করে এনে দ্রুত পাকানোর জন্য তারা ফরমালিন ব্যবহার করে থাকেন। বালতি ভর্তি পানিতে ফরমালিন মেশিয়ে সুচারু লোহার রড ওই পানিতে ভিজিয়ে কাঠালে পুশ করে থাকে। এতেই কাঠাল কয়েক ঘন্টার মধ্যে পেঁকে যায়। সব ব্যবসায়ীরাই এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ফল বিক্রি করছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শরীফুল আলম জানান, পরীক্ষা করার যন্ত্রের অভাবে ফরমালিন প্রতিরোধের উপর অনিয়মিত অভিযান চলছিল। বর্তমানে নতুন মেশিন ক্রয় করা হয়েছে। প্রতি মাসেই ফরমালিনের উপর অভিযান অব্যাহত থাকবে। ফরমালিনের কুফল সম্পর্কে তিনি জানান, ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল করে ফেলে। øায়ূতন্ত্রের ক্ষতি, অতিরিক্ত গ্যাস বা অমলত্তের সৃষ্টি, øায়ূবিক সংবেদনশীলতা নষ্ট, তীব্র রেচনজনিত সমস্যা সৃষ্টিসহ ক্যান্সারের এজেন্ট হিসেবে মানব দেহের ক্ষতি করে ফরমালিন। ফরমালিনের ভয়াবহতা সম্পর্কে ছাতক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাঃ রাজিব চক্রবর্তী জানান, ফরমালিনযুক্ত খাবারে সবশ্রেনীর মানুষের ক্ষতি করে থাকে। স্লো-পয়জনিংএর কারনে প্রাথমিকভাবে বিষয়টি ধরা না পড়লেও পরবর্তীতে এর ভয়াবহতা মানুষকে মৃত্যুর দ্বারে নিয়ে যেতে পারে। শিশুদেরকে ফরমালিনযুক্ত খাবারে মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এছাড়া মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, ঘন-ঘন বমি, চর্ম রোগ সৃষ্টি করে ফরমালিন। পাশাপাশি মানুষের ত্বক নষ্ট হওয়া, ত্বকে সুষ্কতা সৃষ্টি, ত্বক অনুভূতিহীন হয়ে পড়া ও ত্বক শ্বেতবর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। মানব দেহে ফরমালিন প্রবেশের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে কিডনীর। ফরমালিন মুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে গণসচেতনতার পাশাপাশি ফরমালিন বিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
