রাজশাহী প্রতিনিধি : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য আবাসিক হলগুলোর প্রায় প্রতিটি হলেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সাড়ে তিন শতেরও বেশি অবৈধভাবে সিট দখল করেছে। এসব সিটের বেশিরভাগই ফাঁকা রয়েছে। এদিক ছাত্রলীগের অবৈধ সিট দখলের কারণে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী আবাসিকতা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে। নতুনভাবে শুরু হয়েছে ছাত্রলীগের সিট বানিজ্য। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় হল প্রাধ্যক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। অবৈধভাবে ছাত্রলীগ সিট দখলের কারণে প্রতি মাসে অন্তত ৪০ হাজার টাকা সিট ভাড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হল প্রশাসন। এদিকে প্রশাসন থেকে হলে সিট বরাদ্দ দিতে গিয়েও ছাত্রলীগের চাহিদা মতো কক্ষ দিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক ও শাহ মখদুম হল প্রাধ্যক্ষ ইমতিয়াহ আহমেদ বলেন, সিট দখলের নিয়োম অনেক আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসছে। হলের কক্ষগুলোকে উদ্ধার করার জন্য সকল হল প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এক সাথে এগিয়ে আসতে হবে বলে জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সব চেয়ে বেশি সিট নিজেদের দখলে রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান হলে। ওই হলে চার সিটের অন্তত ১৫টি কক্ষ তারা অবৈধভাবে নিজেদের দখলে রেখেছেন। বর্তমানে ওই হলের ২১৬ নং কক্ষ এবং ২১৯ থেকে ২৩২ পর্যন্ত প্রতিটি কক্ষ তারা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। এছাড়াও আরও কয়েকটি কক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক হলে বর্তমানে ৪০টি সিট দখলে রয়েছে। তার মধ্যে এক সিটের ৯টি এবং চার সিটের ৭টি। শাহ মখদুম হলে অন্তত ৩৫টি সিট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তার মধ্যে তিন সিটের ১১টি ছাড়াও আরও একটি কক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে বলে জানা গেছে। আমীর আলী হলে ৫১ থেকে ৫৭ তিন সিটের ৮টি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি কক্ষ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানা গেছে।
নবাব আব্দুল লতিফ হলে ২০২ থেকে ২২০ (জোড়) দুই সিটের ১০টি, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের দুই সিটের ১১টি কক্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ওই হলের ২২০ থেকে ২৩০ নম্বর কক্ষগুলোসহ আর দুটি কক্ষ এখন তাদের কব্জায়।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ হলে ৪০টি, শহীদ হবিবুর রহমান হলে ৩৫টি, শহীদ শামসুজ্জোহা হলে ২৫টি, শহীদ জিয়াউর রহমান হলে ২৫টি এবং মতিহার হলে অন্তত ১৫টিসহ মোট সাড়ে তিন শতাধিক সিট বর্তমানে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানা গেছে।
হল প্রশাসন থেকে কোনো বরাদ্দ না নেয়ায় প্রতি মাসে সিট ভাড়া দিতে হচ্ছে না ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। এতে করে প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১টি হলে অন্তত ৪০ হাজার টাকা সিট ভাড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হল প্রশাসন।
এদিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নতুন করে শুরু করেছে সিট বানিজ্য। আবাসিক হলের বিভিন্ন কক্ষে অনাবাসিক (হলে যাদের সিট নেই) ছাত্রদেরকে তুলে তাদের নিটক থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রতিমাসে প্রত্যক অনাবাসিক ছাত্রদের কাছ থেকে দুই থেকে তিন শত টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও অনেক আবাসিক শিক্ষার্থীর নিকট থেকে প্রতিমাসে মোটা অংকের চাঁদাও নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্রলীগের কর্মী সংকটের কারণে তাদের দখলে থাকা অধিকাংশ সিট ফাঁকা পড়ে আছে। কয়েকটি হলে আবার বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররাও অবস্থান করছে। তারা হল প্রশাসনরে থেকে কোনো প্রকার সিট বরাদ্দ না নিয়েই অবৈধভাবে হলে থাকছেন। এছাড়াও ছাত্রলীগের সিটগুলোতে একাধিক শিক্ষার্থীকে তাদের দলে কাজ করার কথা বলে অবৈধভাবে হলে রাখছেন। এছাড়া বিভিন্ন হলে তাদের নিয়ন্ত্রিত একাধিক কক্ষ বর্তমানে তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন জানান, এ বছরের শুরুর দিকে জিয়াউর রমান হলে ভর্তির পর আমাকে ১১৮ নম্বর কক্ষে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই কক্ষে গিয়ে কোনো সিট ফাঁকা না পাওয়ায় আর হলে থাকার সুযোগ পাইনি। কিন্তু হলে না থাকলেও আমাকে নিয়মিয় হল ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। নূর হোসেন সরকার নামের আরেক শিক্ষার্থী জানায়, আমার এক বন্ধু শাহ মখদুম হলে ভর্তি হলেও তাকে কোনো কক্ষ নম্বর দেয়া হয়নি। সে অনেক খুঁজেও কোনো কক্ষ না পেয়ে বিষটি হল প্রাধ্যক্ষকে জানান। কিন্তু তিনি একাধিকবার আশ্বাস দেয়ার পরও হলে তার সিট হয়নি। এভাবেই অনেক শিক্ষার্থী হলে সিট না পাওয়ার বিষয়ে নিজেদের অসহায়ের কথা তুলে ধরেন। আবার অনেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের যে কক্ষে সিট বরাদ্দ দেয়া হয় সে সেখানে গিয়ে শুনি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আগে থেকেই ওই কক্ষের অন্য বাসিন্দাদের বলে এসেছে ফাঁকা সিটে যেন তারা কাউকে না উঠায়। সেখানে তাদের পরিচিত ছেলে তোলা হবে। অভিযোগ রয়েছে, টাকার মাধ্যমে হলে সিট না হলেও ছাত্রলীগ তাদের হলে জায়গা করে দিয়েছেন।
হলে সিট বানিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগ চায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা যাতে আবাসিকতা নিয়ে হলে ভালো ভাবে থাকতে পারে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরও বৈধভাবেই হলে থাকা দরকার। তবে এই বিপুল পরিমান সিট নিজেদের দখলে রাখার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, এত পরিমাণ সিট কোনো ছাত্রসংগঠনের দখলে আছে তা আমার জানা ছিল না। যদি তারা অবৈধভাবে সেখানে থেকে থাকে এর বিরুদ্ধে হল প্রশাসনকে বলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
