তালাত মাহমুদ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীগণের অনুসারীদের উপর ফরয করা হইয়াছিল। ইহা হইতে আশা করা যায় যে, তোমাদের মধ্যে ‘তাকওয়া’র গুণ-বৈশিষ্ট জাগ্রত হইবে। (আল-কুরআন, ২ঃ১৮৩)
রমযানের মাস। ইহাতেই কুরআন মজিদ নাযিল হইয়াছে, যাহা গোটা মানবজাতির জন্য জীবন যাপনের বিধান আর ইহা এমন সুষ্পষ্ট উপদেশাবলীতে পরিপূর্ণ, যাহা সঠিক ও সত্য পথ প্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য পরিস্কাররূপে তুলিয়া ধরে। কাজেই আজ হইতে যে ব্যক্তি এই মাসের সস্মূখীন হইবে, তাহার পক্ষে এই পূর্ণ মাসের রোযা রাখা একান্ত কর্তব্য। আর যদি কেহ অসুস্থ কিংবা ভ্রমন কার্যে নিয়োজিত থাকে, তবে সে যেন অন্যান্য দিনে এই রোযার সংখ্যা পূর্ণ করিয়া লয়। বস্তুত আলাহ তোমাদের কাজ সহজ করিয়া দিতে চান, কোনরূপ কঠিন কাজের ভার দেওয়া আলাহর ইচ্ছা নয়। তোমাদিগকে এই পন্থা নির্দেশ করা হইতেছে এই জন্য, যেন তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করিতে পার। এবং আলাহ তোমাদিগকে যে সত্য পথের সন্ধান দিয়াছেন সেই জন্য যেন তোমরা আলাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের স্বীকৃতি প্রকাশ করিতে পার এবং তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞ হইতে পার। (২ঃ১৮৫)
হে নবী! আমার বান্দাহ যদি তোমার নিকট আমার সম্পর্কে জিজ্ঞসা করে, তবে তাহাদের বলিয়া দাও যে, আমি তাহাদের অতি সন্নিকটে। যে আমাকে ডাকে, আমি তাহার ডাক শুনি এবং তাহার উত্তর দিয়া থাকি। কাজেই আমার আহবানে সাড়া দেওয়া এবং আমার প্রতি ঈমান আনা তাহাদের কর্তব্য। এইসব কথা তুমি তাহাদের শুনাইয়া দাও, হয়তো তাহারা প্রকৃত সত্য পথের সন্ধান পাইবে। (২ঃ১৮৬)
‘সাওম’ আরবী শব্দ। সাওম বা সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাক। শরীয়াতের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার এবং যৌনাচার থেকে বিরত থাকাকে ‘সাওম’ বা রোযা বলা হয়। বস্তুত ঃ রোযা রাখার নিয়ম সর্বযুগে প্রচলিত ছিল। হযরত আদম (আঃ) থেকে আরম্ভ করে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত নবী-রাসুলরা প্রত্যেকেই সিয়াম পালন করেছেন। আলামা ইমামুদ্দীন ইব্ন কাসীর (রঃ) বলেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিনদিন রোযা রাখার বিধান ছিল। পরে রমযানের রোযা ফরজ হলে তা রহিত হয়ে যায়।
হয়রত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সাঃ) মদীনায় আগমন করে দেখলেন যে, ইযাহুদীরা আশুয়ার দিন রোযা পালন করে। তিনি জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার? তোমরা এ দিনে রোযা পালন কর কেন? তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন। এ দিনে আলাহ তা’আলা বনী ইসরাইলকে শক্রর কবল হতে নাজাত দিয়েছেন। তাই হযরত মুসা (আঃ) এ দিনে রোযা পালন করেছেন। এ কথা শুনে রাসুলুলাহ (সাঃ) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মুসা (আঃ) এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এদিন রোযা পালন করেন এবং সকলকে রোযা পালনের নির্দেশ দেন।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মুসা (আঃ), হয়রত ঈসা (আঃ) এবং তাদের উম্মতরা সকলেই রোযা পালন করেছেন। দিক ধরণ ও প্রক্রিয়াগত কারণে তাদের রোযা আমাদের থেকে কিছুটা ভিন্নতর ছিল।
নবীদের মধ্যে হযরত দাউদ (আঃ) এর রোযা বিশেষভাবে উলেখ্যযোগ্য। আব্দুলাহ ইব্ন আ’স (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে; তিনি বলেন, রাসুলুলাহ (সাঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সকল সময় রোযা রাখ এবং রাতভর নামাজ আদায় করে থাকে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি এরূপ করলে চোখ বসে যাবে এবং দুর্বল হয়ে পড়বে। যে ব্যক্তি সারাবছর রোযা রাখল সে যেন সারা বছরই রোযা রাখল। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশী করার সামর্থ রাখি। তিনি বললেন, তাহলে তুমি ‘সাওমে দাউদী’ পালন কর। তিনি একদিন রোযা রাখতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন। (ফলে তিনি দুর্বল হতেন না) এবং যখন তিনি শক্রর সুম্মখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না।
মাওলানা সৈদয় সুলায়মান নদভী (রঃ) তাঁর সুবিখ্যাত সীরাত গ্রন্থের পঞ্চম খন্ডে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার বরাত দিয়ে লিখেছেন, প্রাচীন মিসরীয়দের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতেও রোযার প্রচলনের নজির পাওয়া যায়। সারকথা-ইসলাম পূর্ব ধর্ম সমূহেও রোযার প্রচলন ছিল। তবে কোন কোন ধর্মে রোযা রাখার ব্যাপারে বেশ স্বাধীনতা ছিল যা রোযার ভাবমূর্তি ও প্রাণশক্তি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছিল। চারিত্রিক মহত্ব, নৈতিক পরিচ্ছন্নতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, আত্মার পবিত্রতা এবং আলাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম রোযা কালক্রম অন্তঃসারশুন্য নিছক এক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।
এ অবস্থা থেকে রোযাকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং একে আত্মিœক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানো নিমিত্তে মহান আলাহ বাব্বুল আলামীন রোযাকে এ উম্মতের উপর ফরয করেন। রোযার ব্যাপারে ইসলামের প্রধানতম দৃষ্টিতে সংস্কার হল, ধারণাগত পরিবর্তন। অর্থাৎ ইয়াহুদীদের দৃষ্টিতে রোযা ছিল বেদনা ও শোকের প্রতীক। পক্ষান্তরে ইসলামের দৃষ্টিতে রোযা হ’ল এমন এক সার্বজনীন ইবাদত যা রোযাদারকে দান করে সজীবতা, হৃদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা। এ রোযার মাধ্যমে বান্দা লাভ করে এক রূহানী তৃপ্তি, নতুন উদ্যম ও প্রেরণা। রোযার উপর আলাহ তা’আলা যে পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন, তা এক মূহুর্তে মানুষকে করে তুলে ভোগে বিতৃষ্ণ, ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান । হাদীসে কুদ্সীতে আছে, আলাহ তা’আলা এরশাদ করেন, রোযা আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর পুরস্কার দান করবো । অপর এক হাদীসে আছে, রাসুলুলাহ (সাঃ) বলেছেন, রোযাদার ব্যক্তি দু’টি আনন্দ লাভ করবে। একটি আনন্দ হ’ল ইফতারের মূহুর্তে আর অপরটি হবে তার রবের সাথে সাক্ষাতের মূহুর্তে।
রোযাদার ব্যক্তির যেন সাধ্যাতীত কোন কষ্ট না হয় এর জন্য নবী করীম (সাঃ) সেহ্রীকে সুন্নাত এবং বিলম্বে সেহ্রী গ্রহণ করাকে মুস্তাহাব ঘোষণা করেছেন। এমননিভাবে ইফতারের সময় অযথা বিলম্ব না করে সময় হওয়ার সাথে সাথেই ইফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কোন কোন প্রাচীন ধর্মমতে রোযা এক বিশেষ শ্রেণীর জন্য পালনীয় ছিল। কিন্তু ইসলাম রোযাকে সকল সীমাদ্ধতা থেকে মুক্ত করে এক সার্বজনীন রূপ দান করেছে। ইসলামী বিধান মতে, প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জন্য রোযা ফরয। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পারে, তারা যেন এ মাসে রোযা পালন করে। (সুরা বাকারা, ২ঃ১৮৫)
সকল প্রাচীন ধর্মেই সৌরামাস হিসেবে রোযা রাখার বিধান ছিল। তাই দিন তারিখ এবং মাসের হিসাব রাখার জন্য সৌর বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও পান্ডিত্যের প্রয়োজন ছিল। এ ছাড়াও সৌরবর্ষের কারণে প্রতি বছর একই সময় নির্দিষ্ট মাসে রোযা রাখতে হত। এতে কোন রদবদল হত না। এতে লোকেরা কিছুটা এক ঘেয়েমী অনুভব করত। কিন্তু সৌরমাসর পরিবর্তে চান্দ্রমাসের হিসাবে রোয়া ফরজ করা হয়েছে। নবী কারীম (সাঃ) বলেন, “চাঁদ দেখে রোয়া আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে তা ভঙ্গ করবে”। রোযাকে চান্দ্রমাসের সাথে সম্পর্কিত করার সুফল হ’ল, এর ফলে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় যে কোন মানুষ খুব সহজেই রোযা রাখতে সক্ষম হবে। এমন কি গহীন বনে, পর্বত-চূঁড়ায় অথবা জনমানবহীন কোন দ্বীপে আটকা পড়া ব্যক্তি অনায়াসে রোযা রাখতে পারে। এর জন্য তার সৌর বিজ্ঞানের প্রয়োজন হয়না। এর আরেকটি সুফল হ’ল চান্দ্র মাসের কারণে ধীরে ধীরে রমযানের সময় বদল হতে থাকে। রমযান কখনো আসে গরমে আবার কখনো বা শীতে। সময়ের এ পরিবর্তনের ফলে নতুনত্বের একট্ াস্বাদ পাওয়া যায়। এতে শীত গরম মৌসুমের সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ সময়কালীন রোযায় অভ্যস্ত হয়ে সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ ও শুকর আদায়ের সুযোগ লাভ করা যায়। রাসুলুলাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে, রমাযান মাসে রোযা রাখবে, নিজেদের সম্পদের যাকাত দেবে এবং তোমাদের শাসকদের আনুগত্য করবে, তবেই তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করবে। ( আলমগীরী, ১ম খন্ড) তথ্যসূত্রঃ ছিরাতুল জান্নাত ও প্রাত্যহিক জীবনে ইসলাম।
প্রিয় পাঠক. আমরা নামাজ আদায় করি, রোযা রাখি। কিন্তু এসবের উৎসের ঠিকানা জানি না। আমাদেরকে যদি সঠিকভাবে নামাজ ও রোযার প্রাচীন ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হয়। আমরা আমাদের ধর্ম সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই জানতে পারি। এছাড়া অন্যান্য নবী-রাসূলগণের আমলে নামাজ ও রোযা রাখার নিয়ম ও পদ্ধতি সম্পর্কে যদি ধারণা দেয়া হয় এবং কিভাবে নামাজ ও রোযার প্রবর্তন হলো-সে সম্পর্কে যদি পুংখানুপংখরূপে অবহিত করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের মাঝে নিয়মিত নামাজ আদায় ও রোযা রাখার প্রবনতা অব্যাহত গতিতে বাড়তে থাকবে। এ ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের অবশ্যই অবশ্যই অগ্রাণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট ।