কুষ্টিয়া প্রতিনিধি :: ‘মিছে এই বাড়িঘর, মিছে টাকাকড়ি, মিছে দৌড়াদৌড়ী, করি কার জন্য, দেখলাম এ সংসার’ গত ৭ মে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের বেডে বসে বাউল করিম শাহ তার জীবনের শেষ এ গানটি গেয়ে শোনান। বাড়িঘর, টাকাকড়ি ও সব মায়া ছেড়ে গতকাল মঙ্গলবার পরপারে চলে গেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল আব্দুল করিম শাহ। সকাল ৮টা ৪০মিনিটের দিকে শহরতলির চৌড়হাস এলাকায় নিজ বাসবভনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল (৮৫) বছর। প্রবীণ এ বাউল শিল্পীর মৃত্যর খবর শুনে তার বাসভবনে ছুঁটে যান কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন, জেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা আব্দুল গনি, বাউল গবেষক ও কলামিষ্ট ফরহাদ মাজহার, বাউল টুনটুন শাহসহ করিম শাহ’র অগনিত ভক্ত ও শিষ্যরা। দীর্ঘদিন বাউল করিম শাহ অ্যাজমাসহ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। দুই দফা জানাযা শেষে মিরপুর উপজেলায় ফুলবাড়িয়া এলাকায় তার এক শিষ্যর দান করা জমিতে শেষ ঠিকানা হয়েছে প্্রবীন এ বাউলের।

বাউলের স্ত্রী রিজিয়া খাতুন বলেন, ঢাকা থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর কয়েকদিন ভাল ছিল। সোমবার রাত থেকে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অসংখ্য লালনের গানের ধারক বাহক প্রবাদ প্রতিম এই বাউল শিল্পীর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বিশিষ্ট বাউল গবেষক লেখক ফরহাদ মজহারসহ শত শত বাউল ভক্ত তার বাড়িতে ছুটে যান। আজীবন লালন সঙ্গীত গেয়ে দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জণ করে আসলেও তার বসবাস ছিলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের পতিত জমিতে। স্বামীকে হারিয়ে তার স্ত্রী এখন বড় অসহায় বোধ করছেন। তবে জেলা প্রশাসন করিম শাহের স্মৃতি সংরক্ষণসহ তার পরিবারের সুরক্ষায় সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন করিম শাহের সব অর্জন হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এমন দাবী স্থানীয়দের।
টুনটুন বাউল জানান, করিম শাহের মত গুনী শিল্পী পাওয়া যাবে না। তিনি আমাদের গুরু ছিলেন। তিনি আদি সুরে লালনের বানীকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত। তার মৃত্যুতে দেশ একজন সহজ সরল বাউলকে হারালো। ফরহাদ মাজহার বলেন, বাউল করিম শাহ জীবিত কেউ তাকে মূল্যায়ন করেননি। অনেক কষ্ট করেছেন। থাকার মত তার নিজের কোন জায়গা ছিল না। এখন হয়তো তাকে অনেকে মূল্যায়ন করবেন।
জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, বাউলের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তার পরিবারের সদস্যদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখা হবে। গত ২৪ এপ্রিল শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রামত্ম হয়ে তিনি কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রথম দিকে আর্থিক দৈনতায় পড়েন। পরে জেলা প্রশাসকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
সেখানে দীর্ঘদিনেও তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় গত ১ জুন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানামত্মর করা হয়। পরে সেখানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে গত ৭ জুন তাকে কুষ্টিয়ার চৌড়হাস ক্যানাল পাড়ার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানেই তিনি গতকাল শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এই বাউলের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার ভক্ত আকমল ফকিরের মিরপুরের বাড়ি তাকে সমাহিত করা হবে। আকমল ফকির জানান, করিম শাহ আমার গুরু ছিল। তাই আমার নিজের জমিতে তার সমাহিত করতে চাই। এ জন্য আমি ৪ কাঠা জমি দিয়েছি।
বাদ যোহর চৌড়হাস ঈদগাহ ময়দানে বাউলের প্রথম জানাযা হয়। পরে বিকেলে আরেক দফা জানাযা শেষে মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের কামারপাড়া গ্রামে ভক্ত আকমলের দান করা জমিতে বাউলকে দাফন করা হয়।
কুষ্টিয়া শহরতলীর মোল্লাতেঘরিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ খাল। তারই পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পতিত জায়গায় একটি কুঁড়ে ঘরে করিম শাহের বসবাস ছিল। নানা কারনে পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া ৫৫ বিঘা জমি বিক্রি করে দিতে হয় এ বাউলকে। পরে তার নিজের ঠাঁই হয় সরকারি জমিতে।
আব্দুল করিম শাহ খুব ছোট বেলায় লালন মতে দীক্ষা নেন। এর পর আমৃত্যু তিনি লালনের সুর সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। তিনি লালন সঙ্গীতের আদি ধরে রাখার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। তীব্র আর্থিক দৈন্যতা থাকলেও তার সুর সাধনায় ব্যাঘাত ঘটেনি। এসব কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ২০১১ সালে একুশে পদকে ভুষিত হন। বাউল আবদুল করিম তরুণ বয়সে লালন সাঁইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। জীবনাবসান অবধি লালনের গান গেয়েছেন। আমেরিকা, ফ্রান্স, লন্ডন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে সংগীত সফর করেছেন তিনি। ২০১১ সালে শিল্পকলায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে এক লাখ টাকা দেন।
বাউল আব্দুল করিম শাহ ১৯২৯ সালের ১২ জুলাই মিরপুর উপজেলা অঞ্জনগাছী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ঝুমুর আলী জোয়াদ্দার ও মাতা কুসুম নেছা। ৩ ভাই বোনের মধ্যে করিম শাহ সবার বড় ছিলেন। করিম শাহ’র প্রথম স্ত্রীর নাম হালিমা বেগম। সেই সংসারে তার দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। হালিমা বেগম মারা যাবার পর ছেলেদের সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ ছিল না। পরে তিনি রিজিয়া নামের এক মহিলাকে দুই মেয়ে সন্তানসহ বিয়ে করেন।
করিম শাহ’র ওস্তাদ ছিলেন নিতাই শাহ ও গানের গুরু ছিলেন বিহাল শাহ। ছোট বেলা থেকে বাউল গানে ঝুকে পড়েন আব্দুল করিম। একুশে পদক ছাড়াও বাউল আব্দুল করিম ১৫টি পুরস্কার লাভ করেন।
জেলা শিল্পকলা একাডেমী ও লালন আঁখড়ার একাডেমীতে তিনি বেশ কয়েক বছর শিক্ষক হিসেবে নবীন শিল্পীদের ক্লাস নিয়েছেন। লালনের অনেক কম অপ্রচলিত গান আব্দুল করিম শাহ আদি সুরে গেয়েছেন।
