তাপস চন্দ্র সরকার, কুমিল্লা : আর কত ফডো (ছবি) তুলবেন বাবারা ‘ও’ আমার বাবাহাউদ্দিনরে মাইরা লাইছে ও আল্লাগো। টেহার লোভে আগুন দিয়া মারছে গো ও আল্লাগো। সাংবাদিকরা কাছে যেতেই এভাবে আর্তনাদ করে কাদঁতে শুরু করেন, হোমনা উপজেলার চান্দের চর গ্রামের হাজী মোঃ ইসমাইল হোসেনের ছেলে সৌদী আরবে অগ্নিকান্ডে নিহত বাহাউদ্দিনের দুঃখিনী মা সাহিদা বেগম।

সৌদি আরবের রিয়াদে সিফা সানাইয়া সড়কে তিতাস ফার্ণিচার ফ্যাক্টরীতে গত ১২ মে অগ্নিকান্ডে নিহত ৯জনের মধ্যে বাকী ৩জনের লাশ গত মঙ্গবার বিকালে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর আসে। সেখান তাদের স্বজনরা লাশবাহী গাড়ীতে করে রাত ৮টার দিকে নিহতদের গ্রামের বাড়িতে পৌছায়। এসময় অপেক্ষমান স্বজনদের মধ্যে এক আবেগঘন মূহুর্তের সৃষ্টি হয়। নিহতদের মধ্যে কুমিল্লার তিতাসের নারান্দিয়ার মোঃ নাজির (২৮), হোমনা উপজেলার চান্দেরচর গ্রামের বাহাউদ্দিন (৩০) ও মেঘনা উপজেলার শিবনগরের আব্দুল গাফ্ফার (৩০)। গতকাল বূধবার তিনজনের লাশ তাদের গ্রামের বাড়িতে পৃথক পৃথক জানাজা শেষে দাফন করা হয়েছে। নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাহাউদ্দিনের পরিবারের করুণ আর্তনাদের ভয়াল চিত্র। গত ১২মে থেকে প্রিয় স্বামীর বধনটুকু দেখার অপেক্ষায় শোকের ঊর্নাজাল বোনে অনাহারে কঙ্কালসার স্ত্রী শাহনাজ ঘরে ভেতর সজ্জাশায়ী বিলাপ করতে পারছেনা। একটু উঠতে চায় আবার পড়ে যায় দুর্বল হয়ে পড়েছে দেহটা। তাকে সান্তনা দিচ্ছে প্রতিবেশীরা। বড় শখ করে বাহাউদ্দিনের বাবা মা বিয়ে করিয়েছিলো পাশের বাড়ীর ইউসুফ মিয়ার মেয়ে শাহনাজকে। কি নিষ্ঠুর নিয়তি সুখটুকু আর সইলনা। একমাত্র সন্তানটিও দেখে যেতে পারলো না হতভাগা বাহাউদ্দিন কি নির্মম পরিহাস ! না দেখলো ছেলে বাবার মুখ। পরিবারের পাচঁ ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার ছোট বাহাউদ্দিন। নিহত বাহাউদ্দিনের বৃদ্ধ বাবা হাজী মোঃ ইসমাহিল হোসেন আদরের সবচেয়ে ছোট সন্তানটিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। ছেলের কফিনে ধরে বির বির করে যেন কিছু বলতে চাচ্ছে ! কিন্তু গলার শব্দ ভসে গেছে, কোন কোন কথাই বুঝাÑই যাচ্ছে না। ফেল ফেল তাকিয়ে আছে আগতদের পাণে। স্বজনদের বিলাপের ধ্বনিতে ভারি হয়ে উঠছে এলাকার আকাশ বাতাস। চোখের জল ধরে রাখতে পারছে আগতরাও। তাদের আহাজারিতে নিভৃতে যেন কাদঁছে প্রকৃতিও। ১১টায় চান্দেরচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বাহাউদ্দিনের জানাজা শেষে চান্দেরচর কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশনেন হোমনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট আজিজুর রহমান মোল্লা ও থানার অফিসার ইনর্চাজ মোঃ কামরুজ্জামান সিকদারসহ এলাকার কয়েক হাজার মুসল্লি।, মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা থেকে স্বজনদের পরিবারের সদস্যরা নিহত তিন শ্রমিকের লাশ গ্রহন করেন। বুধবার সকালে নিহত শ্রমিকদের স্ব-স্ব বাড়িতে দাফন করা হয়। এদিকে, তিতাসের নিহত নাজির হোসেন (২৮) এর বাড়িতে গেলেই চোখে পড়ে তার মা জুলেখা বেগমের বুকফাটা আর্তনাদ।ওঠানের মধ্যে নাজির হোসেনের বৃদ্ধ মা জুলেখা বেগম মাটি চাপড়ে বিলাপ করে বলছেন, ‘তোগোরে ছোট ফালাইয়া তোর বাবা মরল। আর তুই আমার সংসারকে উজ্জল করে দিল। “আমার সোনার ধন মানিক, সংসারের সবার জন্য চলার মত করে দিল। আর তোর লাইগা বিয়ের জন্য মাইয়া দেখলাম। কারে আমি বিয়া করাইমোরে পুতরে।” ‘পুতরে তোর মরার আগে আল্লায় কেন আমারে মরণ দিল নারে..। জীবনের আর মরণের বিয়া এক লগে হইলরে ‘ও’ নাজিররে।” বড় শখ ছিলো ছেলে এবার বিদেশ থেকে এলে ছেলেকে নিজ হাতে গোসল দিয়ে বিয়ে করাবে। ছেলে সাথে বর যাত্রিতে যাবে। আশায় গুড়েবালী স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান। মা জুলেখা কি জানতো ! ছেলের শেষ বিয়ের চলন প্রস্তুত হয়ে আছে। নিজ হাতে বিয়ের গোসল না দিয়ে শেষ গোসল দিতে হবে! পাগলিণী মা ওঠানে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বুক চাপড়ে এভাবেই বিলাপ করছে, ভাই-বোন সবায় মাটিতে গরাগরি করে কাঁদছেন। কারো কান্না কেউ যেন থামাতে পারছেনা। নারানন্দিয়া গ্রামের চকের বাড়ির জমশের আলীর ছেলে নাজির হোসেন। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরার জন্য ২০০১সালে শেষ সম্ভল বিক্রি করে সৌদি আরবে যায়। সাত ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় নাজির হোসেন। সংসারের ভাই বোনকে সচ্ছল করতে বিদেশ গিয়েছিলেন; একটু আয়ের মুখও দেখেছিলেন মাত্র। নাজির হোসেনের মৃত্যুতে সেই যেন আলোর মুখ আধাঁরে ডেকে গেল! পরিবারটির চোখে এখন ধোঁয়াশা আর হতাশার ধু ধু বালুচর। সকাল ১০টায় চকের বাড়ির মসজিদ প্রাঙ্গণে নিহত নাজির হোসেনের জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশগ্রহন করেন, নারানন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার সালাহ উদ্দিনসহ কয়েক হাজার লোক।
অপরদিকে, মেঘনা উপজেলা শিবনগর গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে আবদুল গাফফার (৩০) এর লাশ তার বাড়িতে পৌছলে স্বজনদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যায়। উপজেলার শিবনগর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তার লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মেঘনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুস ছালামসহ কয়েক হাজার লোক জায়নায় অংশ গ্রহন করেন।
অগ্নিকান্ডের ব্যাপারে সকল পরিবারের লোকেরা অভিযোগ করে বলেন, ফ্যাক্টরির মালিক মইনুল ইসলাম দেশে বেড়াতে এলে ওই ফ্যাক্টরির পরিচালনার ভার দিয়ে আসে তার ভাই রাজউদ্দিনের হাতে। আর অর্থ পরিচালনার ভার থাকে শ্রমিকদের কাছে। এই ফ্যাক্টরিতে একই সাথে কাজ করতো চান্দের চর গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে মাসুম। নিহতের পরিবারেরা জানায়, রাজউদ্দিন ও মাসুম জুয়ারী ছিলো তাদের জুয়া খেলা বন্ধ করার জন্য বাকী শ্রমিকরা চাপ দেয়াই কাল হয়ে দাড়িয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। তারা জানান, অগ্নিকান্ডের সপ্তাহ খানেক পূর্বে মেরে আহত করে এরা দু’জনে। সেখানের একটি হাসপাতালে ভর্তিও ছিলো। তারা জানান, অগ্নিকান্ড ঘটার আগেই সকলের মোবাইল গুলো মাসুম নিয়ে নেয়। অগ্নিকান্ডের পরও মাসুম সেই মোবাইল গুলো থেকে ফোন দিয়েছে। সেই মোবাইল গুলোতে এখনো রিং হয়। তারা বলছেন, মানুষ যেখানে পুড়ে ছাই সেখানে মোবাইল ভালো থাকে কী করে! একই কথা বলেছিলেন ফ্যাক্টরির মালিক মইনুল অগ্নিকান্ডের পরদিন (১৩ মে সন্ধ্যায়) ০১৮৪২২৯৯৭৭৫ এই নাম্বারটি থেকে ০১৯৩৯৫৯৯২৯১ নাম্বারে। স্বজনহারা পরিবারগুলোর দাবী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে রহস্য উদঘাটন করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন।
উল্লেখ্য- সৌদির তিতাস ফানির্চারে ১৫জন শ্রমিক কাজ করতো। সেখানে ১২মে রাত ১০টার দিকে রহস্যজনকভাবে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৯ বাংলাদেশীসহ ১১জন নিহত হন। ৯ বাংলাদেশীর মধ্যে ৭ জনের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস, হোমনা ও মেঘনায়। এদের মধ্যে ৩০ মে প্রথম দফায় ৬ জনের লাশ দেশে আসে।
