শরিফুল ইসলাম শরীফ, ভোলাহাট(চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : বাংলাদেশ–ভারত পাশাপাশি দু’টি দেশ আর বাংলাদেশের পশ্চিম-উত্তরে অবস্থিত একেবারেই তিনদিক থেকে বেষ্টিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ছোট্ট একটি উপজেলা। প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার লোকসংখ্যা নিয়ে ভোলাহাট উপজেলার অবস্থান। উপজেলার বেশীর ভাগই লোক কৃষিজীবির উপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজ আর গরুর গোহাল ঘর সামলাতে তাদের দিনমান চলে যায়। সূত্রমতে, তাদের পড়ালেখার মানের হার মোটামোটি ভাবে বর্তমানে একটু ভালো হলেও ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-সাদীর ব্যাপারে তারা একেবারেই আনাড়ী। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এ প্রজন্মের কাছে তারা যেন হার মানছে। সেই মান্দাত্তা আমল থেকেই চলে আসছে ছেলে-মেয়েদের বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৫/১৬ বছর, আর মেয়েদের ১০/১২ বছর হলেই যেন বাবা-মায়ের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কখন তারা ছেলেমেয়েদের বিয়ে-সাদী শেষ করবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। মেয়েরা বাবা-মায়ের কাছে যেন একটি বড় ধরণের বোঝা। এক সময় ছিলো বাবা-মায়ের কাছে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-সাদীটা বড় ধুমধামের সহিত সম্পন্ন করতো, তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-সাদীর ব্যাপারে। আর এখন এ বিয়ে-সাদীকে তারা সমস্যা মনে করছে এবং অতি গোপনে দায়সারা করে সমাধা করছেন বলে প্রত্যক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে মা-বাবার সন্তান যদি হয় মেয়ে, তাহলে সেটা এক অভিশাপ। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, উপজেলার বেশীর ভাগই মানুষের অসচেতনতার অভাবেই তারা মেয়েদের তুলে দিচ্ছেন এক নারকীয় তান্ডবলীলার মধ্যে এ ব্যাপারে তারা একেবারেই অজ্ঞ। বাবা-মা মেয়েকে বিয়ে-সাদী দেয়ার পূর্বে যদি জানতো, তাঁদের মেয়েকে অপ্রাপ্ত বয়সে তুলে দিলে, তাঁর শ্বশুড় বাড়ীতে তাদের মত করে স্নেহ-আদর করবে কি-না তাঁর মেয়ের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে পারবে তো ! তবে এ ব্যাপারে মেয়ের মা যদি জানতো আমার মেয়েকে কি ধরণের পরিস্থিতির শিকার হতে হবে, তাহলে মা কোনোদিনই তাঁর মেয়েকে সাদী-বিয়ে দিতে পা বাড়াতো না।

সূত্রে জানা গেছে, ভোলাহাট উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে সদর ইউনিয়নের গ্রাম গুলিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হলেও, পরবর্তীতে বাল্যবিবাহের কাজে যারা জড়িত, তারা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পাশ্ববর্তী উপজেলা গোমস্তাপুরের রহনপুরে কাজী অফিসে তাদের গোপন বাল্যবিবাহের কাজটি সমাধা হচ্ছে বলে প্রত্যক্ষ করা গেছে। উলেখ্য, উপজেলার দলদলী ইউনিয়নের চামামুশরীভূজা গ্রামের মোস্তফার মেয়ে বর্ষা (১১) ও বটতলা (খাসপাড়া) গ্রামের ভেজালু নাপিতের ছেলে মাসুদ (১৬)’র সাথে বিবাহ দিন গত ০৩/০৯/২০১৩ ইং তারিখে বিয়ে হবার কথা থাকলেও উপজেলা প্রশাসন ও ইউপি চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে বন্ধ হলেও, পরবর্তী সময়ে তরিঘরি করে উক্ত বর-কনের বাবা-মা রহনপুর নিকাহ রেজিষ্ট্রার অফিসে তাদের বিয়ে দেয় বলে জানা গেছে। স¤প্রতি, উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন গ্রাম তেলীপাড়া ও ধরমপুর। এ দু’গ্রামের সহোদর দু’ভাইয়ের একই দিনে বিয়ে চলাকালিন সময়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী জিয়াউল বাসেতের হস্তক্ষেপে বিয়েটি বন্ধ হলেও তারাও একই পন্থা অবলম্বন করে তাদের বিয়ের কাজ শেষ করে। এর আগেও উপজেলার বৃহত্তম গ্রাম বজরাটেক। আর এ গ্রামের সাথে রয়েছে, পিরানচক, মুন্সিগঞ্জ, কানারহাট, রাধানগর কলোনী, খালেআলমপুর সহ বিভিন্ন গ্রামে হরহামেসায় ঘটছে এ বাল্যবিবাহের মত অভিশাপের কাজ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ নজর দিলেও বন্ধ হচ্ছে না বাল্যবিবাহের মত অভিশাপের কাজ। অভিজ্ঞমহল বলছেন, বর্তমান এ প্রযুক্তির যুগে এসেও ছেলে-মেয়েদের মা-বাবা যদি সচেতন না হয় তাহলে ভবিষ্যতে এদেশটি জনসংখ্যার ভারে রসাতলে যাবে এবং দ্রুত দারিদ্রতা কষাঘাতে ও বিপুল জনসংখ্যার চাপে উন্নয়নের ধারা লোপ পাবে।
জানা গেছে, বিবাহ বা নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার অফিস গুলির নিয়ম-নীতিকে তোয়াক্কা না করে তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা এ নেক্কারজনক ঘটিয়ে যাচ্ছে বাল্যবিয়ে। এ ব্যাপারে উপজেলার বিভিন্ন অভিজ্ঞমহল বলছেন, উপজেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিয়ে বন্ধ করছে আর পরবর্তী সময়ে ছেলে-মেয়েদের মা-বাবা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পরিকল্পিতভাবে তারা বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ কাজী ও নিকাহ রেজিষ্ট্রারগণের কাছে অবৈধভাবে বাল্যবিবাহ দিচ্ছে, তাহলে তাদের খুটির জোর কোথায়? তারা আরো বলছেন, আইন আছে, আইনের যথাযথ ব্যবহার নেই, আজ রক্ষকই হয়েছে ভক্ষক। ভোলাহাট উপজেলায় সেই মান্দাত্তা আমল থেকেই চলে আসছে এ বাল্যবিবাহের অভিশাপ। কিছুটা হলেও সচেতন হলেও অসচেতন রয়েই গেছে, অজো পাড়া-গাঁয়ের লোকসকল। তারা তাদের চোখের সামনে এক বা একাধিক পরিবারের মধ্যে বাল্যবিবাহ দেয়াতে তাদের মেয়েরা ফিরে আসছে তার বাপের বাড়ীতে বিধবার পোষাক পড়ে। তবুও তারা একটুও সচেতন হয়নি, তার পরিবারে যদি এ ধরণের পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। সচেতনমহল বলছেন, সরকারের আইন রয়েছে, কিন্ত্র এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। আর তাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিলে অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলের পা ফাটা মানুষগুলি কিছুটা হলেও সচেতন হয়ে তারা আসল বিষয়টি অবগত হবে এবং বাল্যবিবাহের মত অভিশাপের হাত হতে রক্ষা পাবে বলে তারা মনে করেন।
সরজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ভোলাহাট উপজেলার বৃহত্তর গ্রাম বজরাটেক। আর এ গ্রামে স¤প্রতি একটি বাল্যবিয়ের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহে গেলে তাকে লাঞ্চিত ও অপমানিত হতে হয়। ঘটনাটি ছিলো বজরাটেক গ্রামের ১৪ বছরের শিশু কন্যার সাথে গোপনে রাতে বিয়ের কাজ সমাধা হতে যাচ্ছিল পার্শ্ববর্তী গ্রাম খালেআলমপুর গ্রামের ছেলের সাথে। গভীর রাতে ভোলাহাট থানা-পুলিশ অবগত হলে সরজমিনে আসে পুলিশ এবং মেয়ের কাগজ-পত্রাদি দেখে বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী বিয়ে বন্ধের দু’দিন যেতে না যেতেই ঐ মেয়ে ও ছেলের বাল্যবিয়ে সমাধা হয়ে যায়। ঐ এলাকাবাসী বলছে, তাহলে এখানে পুলিশের কি মুল্যায়ন করলো ঐ মেয়ে-ছেলের বাবা ও মায়ের কর্তৃপক্ষ। পুলিশ কি তাহলে কালো টাকার বিনিময়ে ঐ বিয়ে দিতে হুকুম দিয়েছে নাকি বর-কনের কর্তৃপক্ষ গোপনে এ কাজ করেছে ? সবার মুখে মুখে এ একই প্রশ্ন। আমরা তাহলে কালো টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছি নাকি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ টুকুও আমাদের উঠে গেছে। এ কোন দেশে আমরা বসবাস করছি ? স্বাধীন দেশের মানুষ এতোই স্বাধীনতা নিতে শিখেছি যে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কোন তোয়াক্কা করি না। এ কারণে এলাকায় কথা উঠেছে আইন আছে আইনের সুষ্টু প্রয়োগ নেই। বাল্যবিবাহের কাজে জড়িত বৈধ বা অবৈধভাবে নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারদের খুটির জোর কোথায় ?
এ ব্যাপারে ভোলাহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী জিয়াউল বাসেত বলেন, উপজেলায় এ ধরনের বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটলে, আমাকে জানালে তা দ্রুত আইনানুগ ভাবে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সাথে সাথে স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতা একান্ত ভাবে কামনা করছি। আমার একার পক্ষে তো সম্ভবপর হবে না। বাল্যবিবাহের ব্যাপারে ভোলাহাট থানা অফিসার্স ইনচার্জ এস.এম আবু ফরহাদ এ প্রতিবেদককে বলেন, আইনের উর্ধ্বে কেউই নয়, পুলিশ কারো শত্র“ নয় বরং বন্ধু। তাই পুলিশের সাথে যোগাযোগ রাখলে অবশ্য সাধারণ মানুষ উপকার পাবে, অপকার নয়। তাই এ উপজেলায় বাল্যবিবাহের ব্যাপারটি গোড়াগোড়িই শুনে আসছি। তবে আমাকে তাৎক্ষনিক ভাবে জানালে আইনের ধারায় এনে বাল্যবিবাহের ব্যাপারে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি আশ্বাস প্রকাশ করেন।
