১৯৫১ সালে ত্রিপুরা (বর্তমানে বৃহত্তর কুমিল্লা) জেলা আওয়ামীলীগ গঠিত হয়। তার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন এ্যাডভোকেট আবদুর রহমান খান। এ্যাডভোকেট আবদুর রহমান খানের বাসা ছিলো পুরাতন চৌধুরী পাড়ায়। বাড়ীটি বর্তমানে হস্তান্তর হলেও তার গেইটে মন্ত্রী বাড়ী’ নামটি খচিত রয়েছে। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং শরীফ আবদুল্লা হারুন সাধারণ সম্পাদক। আমরা উভয়েই পুরাতন চৌধুরী পাড়াস্থ প্যারাডাইস হোস্টেলের (যাহা আমোদ পত্রিকা অফিসের উত্তর দিকস্থ ভগ্ন প্রায় বিরাট দালানটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো) আবাসিক ছাত্র। ফলে জেলা আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র বিন্দু ছিলো পুরাতন চৌধুরী পাড়া। সে সুবাদে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী এবং শেখ মুজিবের কুমিল্লার ঠিকানা ছিলো এ্যাডভোকেট আবদুর রহমান খানের চৌধুরী পাড়াস্থ বাসাটি। ১৯৬৪ সালে এ্যাডভোকেট আবদুর রহমান খান জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং আমি সাধারণ সম্পাদক হই। একই সাথে আমি ৩৯ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য হই। উল্লেখ্য, আমি ১৯৬১ সালে কুমিল্লা বারে যোগদান করি এবং ১৯৬২ সালে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হই। আমার বাসাটি প্রথমে ছিলো রেইসকোর্সে এবং পরে বাগিচাগাঁয়ে নিজস্ব বাসায় চলে আসি। বলা প্রয়োজন যে, উভয় বাসাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্বে অবস্থিত। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রশ্নে আওয়ামীলীগে মতবিরোধ দেখা দিলে এ্যাডভোকেট আবদুল রহমান খান আওয়ামীলীগ ত্যাগ করে নবগঠিত এনডিএফ-এ যোগদান করেন। ফলে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দের কুমিল্লার ঠিকানা পুরাতন চৌধুরী পাড়া হতে বাগিচাগাঁয়ে স্থানান্তরিত হয়। এটা পরে আলোচিত হবে। তার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারটা আলোচনা প্রয়োজন মনে করি।
১৯৬৭ সালে ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠণের জন্য বঙ্গবন্ধু তিন দিনের জন্য বৃহত্তর সিলেট জেলা সফরের কর্মসূচী দিয়ে সড়ক পথে সিলেট যাবার ঘোষণা দেন। আমি বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা আওয়ামীলীগের জরুরী সভা করে দাউদকান্দি ফেরীঘাটে সংবর্ধনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে সিলেট সীমান্তে পৌঁছে দেবার সিদ্ধান্ত নেই। নির্ধারিত দিনের পূর্ব রাতে চাঁদপুরের নেতৃবৃন্দ কুমিল্লায় এসে অবস্থান নেন। জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং আমার স্ত্রীর সম্পর্ক চাচা-ভাতিজি। সে সুবাদে তিনি আমার বাসায় অবস্থান নেন। আমরা রাতের খাবার খেয়ে কথাবার্তা বলাকালে হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। রিসিভার উঠাতেই অপর প্রান্ত হতে বঙ্গবন্ধু বলে ওঠেন, শুনলাম আবদুর রহমান খানের স্ত্রী বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাসরত। আমি জীবনে বহুবার তার হাতের খাবার খেয়েছি। সুতরাং সিলেট যাবার পথে তার সাথে দেখা করে যাব। এটা জানিয়ে দাও। আমি সাথে সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টেলিফোনে এটা আবদুর রহমান খানকে জানালে তিনি হঠাৎ বলে ওঠেন, শেখ মুজিব আমার বাসায় না এলে খুশী হবো। আমি উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠি, এটা অতি বাড়াবাড়ি হচ্ছে। প্রয়োজন বোধ করলে আপনি বাড়ী হতে সরে যেতে পারেন। সুতরাং আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসবই জানিয়ে দিলাম। সে মতেই পরদিন গেলাম এবং বঙ্গবন্ধু আবদুর রহমান খানের স্ত্রীর সাথে দেখা করে তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। কৃতজ্ঞতার পালা এখানেই শেষ হলো না। সত্তরের নির্বাচনের কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন আবদুর রহমান খানের বহু অবদান রয়েছে। তিনি রাগ বা অভিমান করে আওয়ামীলীগ ছেড়ে চলে গেছেন। তুমি তার বড় ছেলে হুমায়ুনকে নিয়ে আস। আমি মনোনয়ন দেব। সাথে সাথে আবদুর রহমান খানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ছেলের মনোনয়ন চাওয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানান। এ গেলো বঙ্গবন্ধুর কৃতজ্ঞতা বোধের ঘটনা।
এখন নিজের ব্যাপারে আসা যাক। উপরে উল্লেখ করেছি যে এ্যাডভোকেট আবদুর রহমান খানের আওয়ামীলীগ ত্যাগ করার পর আওয়ামীলীগের ঠিকানা আমার বাসায় স্থানান্তরিত হয়। আমার বাসাটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। ফলে জাতীয় নেতৃবৃন্দতো বটেই কক্সবাজার হতে সিলেট অঞ্চলের নেতৃবৃন্দেরও এ পথে ঢাকায় যাওয়া আসার পথে আমার বাসায় যাত্রা বিরতি ছিলো অনিবার্য। ফলে অতিথি আপ্যায়ন প্রতিদিনের নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দেখা দেয়। সে সময় দাউদকান্দি হতে ঢাকা পর্যন্ত তিনটি ফেরী ছিলো। ফেরীগুলো রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যেতো। ফলে এ অঞ্চল হতে ঢাকায় যাবার পথে কুমিল্লায় পৌঁছতে নয়টা বেজে গেলেই বঙ্গবন্ধু আর অগ্রসর না হয়ে আমার বাসায়ই রাত যাপন করতেন। আর যেদিন এমনটি ঘটতো সেদিন রাতে বাসায় ঘুমই হতো না। কারণ বঙ্গবন্ধু অগ্নিযুগের অগ্নি পুরুষ বাবু ধীনেন্দ্র নাথ দত্তকে এবং বিপ্লবী অতীন রায়কে ডেকে এনে রাতভর আলাপ আলোচনায় মত্ত থাকতেন। অপরদিকে আমার স্ত্রী সারা রাত জেগে থেকে তাদের চা সরবরাহ করতেন। মনে পড়ে যেদিন বঙ্গবন্ধু প্রথম আমার বাসায় রাত যাপন করেছিলেন, সেদিন তার জন্য পোলাও কোর্মা পাক করা হয়েছিলো। এগুলো দেখে বঙ্গবন্ধু আমার স্ত্রীকে ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন তুমি কি আমাকে মেহমান মনে করছো? অতঃপর বলে ওঠেন, মনে রেখো এসব খাবার আমার পছন্দ নয়। আমার পছন্দ হলো টাকি মাছের ভর্তা এবং ডাল। অতঃপর তিনি যেদিনই এসেছেন সেদিন তার পছন্দের খাদ্যই পরিবেশন করা হতো। তারপর তিনি প্রায়ই বলতেন, আমার স্ত্রীর হাতের টাকি মাছের ভর্তায় নাকি তিনি আলাদা স্বাদ পান।
এবার রাজবন্দি ব্যাপারে আসা যাক। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিভাগের কেন্দ্রীয় কারাগারটি কুমিল্লায় অবস্থিত। ফলে এ কারাগারটিতে সারা বছরই একাধিক আওয়ামী নেতা রাজবন্দি হিসেবে আটক থাকতেন। আর তাদের দেখভাল আমাকেই করতে হতো। প্রতি পনর দিন অন্তর তাদের সাথে সাক্ষাতের নিয়ম ছিলো। এ সাক্ষাতের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে প্রথম ডিসি অনুমতি নিয়ে তারপর যেতে হতো ডিএসবি অফিসে। সেখানে সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করা হতো। তারপর আত্মীয়-স্বজন সাক্ষাত করতেন। এখানকার আনুষ্ঠানিকতা আমাকেই সম্পন্ন করতে হতো। অতঃপর আমার বাসায় অপেক্ষমান আত্মীয়স্বজনকে জেল গেইটে এনে সাক্ষাত করানো হতো। তারপর বাসায় নিয়ে খাবার পর্ব শেষে বিদায় করা হতো। উল্লেখ্য, একবার খন্দকার মোস্তাক, জুহুর আহমেদ চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং রাজশাহীর মুজিবর রহমানকে এক সাথে কুমিল্লা কারাগারে আনা হয়। এ সময় প্রায় প্রতিদিন হাজতিদের মাধ্যমে তাদের চাহিদার চিরকুট পেতাম। এ চাহিদা মিটাতে একদিকে হিমশিম খেতে হতো, অপরদিকে প্রতি মাসেই তাদের সাথে সাক্ষাতের আনুষ্ঠানিকতা করতে করতে নিজের পেশারও ভীষণ ক্ষতি হতো। তা ছাড়া সাক্ষাতকারিদের খানাপিনার কথা বলাই বাহুল্য। তারা চারজন চলে যাবার প্রায় সাথে সাথেই জিল্লুর রহমান (পরবর্তিতে রাষ্ট্রপতি) এবং আবদুর রাজ্জাককে কুমিল্লা জেলে আনা হয়। ফলে প্রতি মাসে দুবার বেগম জিল্লুর রহমান এবং বেগম রাজ্জাক আত্মীয় স্বজনসহ এক সাথে আসতেন। এখানেও একই ঝামেলা পোহাতে হতো। এখানে উল্লেখ্য যে, বাইরের ঝামেলা আমি মোকাবিলা করতাম এবং ঘরের ঝামেলা আমার সদ্য প্রয়াত স্ত্রী হোসনে আরা আহমেদ। এখানে আরো উল্লেখ করা যায় যে, আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ঠুকে দিয়ে হয়রানী করা ছিলো স্বৈরাচার শাসক গোষ্ঠির নিত্য দিনের ঘটনা। বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো শুধু পরিচালনাই করতে হয়নি, তার খরচাদিও যোগান দিতে হয়েছে আমাকেই। ফলে এ সব খরচাদি এবং নিত্যদিনের অতিথি আপ্যায়নের কারণে সংসারে অভাব অনটন ছিলো আমার চিরসাথি। আর তার অংশীদার ছিলো কুমিল্লার বাঘা পুরুষ খ্যাত অন্যতম শীর্ষ আইনজীবী আবদুল গফুর ভুইয়ার (গফুর মোক্তার) কন্যা আমার সহধর্মিনী সদ্য প্রয়াত হোসনে আরা আহমেদ। প্রাচুর্যে জন্ম এবং বর্ধিত হওয়া সত্বেও আমার নুন আনতে পানতা ফুরায় এ সংসারকে যেভাবে সামাল দিয়ে গেছে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। মুক্তিযুদ্ধকালে আমি পূর্বাঞ্চল যুব শিবির উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান (স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের তৃতীয় খণ্ডের ৬২১ পৃঃ সন্নিবেশিত) ছিলাম। প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা বিলি বন্টন করেছি। অতঃপর মুক্ত কুমিল্লার প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। এ সময় কোটিপতি হওয়াটা ছিলো শুধুমাত্র ইচ্ছার ব্যাপার। হলপ করে বলতে পারি এ ইচ্ছাটা মনের কোনে কখনোই উদয় হয়নি। অবশ্য এটা মানসিকতারও ব্যাপার। উল্লেখ্য, ভোগে নয়, ত্যাগে আত্মতৃপ্তি সম্পন্নগণই রাজনীতিবিদ, আবার ত্যাগে নয়, ভোগে আত্মতৃপ্তি সম্পন্নগণ সওদাগর এবং ‘যখন যাহা তখন তাহা’ করার মানসিকতা সম্পন্নগণ আমলা হতেন। কিন্তু এক্ষণে এই বিভাজনটা তিরহিত। ফলে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় বাড়ীতো দূরের কথা, এক খণ্ড জমিও নেইনি। শুধু তা নয়। কুমিল্লায় প্রথম জীবনে যে বাশের বেড়ার ঘরটি তৈরী করেছিলাম, তার মালিকানা নিয়েই আজো বসে রয়েছি। অবশ্য বসবাস করছি হাউস বিল্ডিং ফাইনেন্স করপোরেশনের বহুতল দালানে। ফলে সমাজেরতো বটেও, সন্তানদের কাছেও বোকার হদ্দ হয়ে রয়েছি। বলা প্রয়োজন, এখানে আমার সহধর্মিনীই হলো একমাত্র ব্যতিক্রম। কারণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাড়ী গাড়ী না করার অভিযোগ কোনদিন তার কাছ থেকে পাইনি। যে সারা জীবন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মিদের নীরবে সেবাদান করে গেছে। তাইতো তার মৃত্যুর পর তদানিন্তন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ঘন ঘন টেলিফোন পাচ্ছি। এখানে সকলেরই একটিই কথা, তা’হলো চাচীকে জ্বালাতন করেছি অনেক। এখানে উলে¬খ্য যে, আমার রাজনৈতিক জীবনে একবার মাত্র তার কাছ থেকে বাঁধা পেয়েছি। তা হলো ২০০১ সালের নির্বাচনের প্রায় দু’মাস পূর্বে একদিন জুমার নামাজ শেষে বাসায় এলে আমার স্ত্রী একটা টেলিফোন নাম্বার আমার হাতে দিয়ে বলে যে ঢাকা হতে কে একজন এ নাম্বারে টেলিফোন করতে বলেছে। সাথে সাথে টেলিফোন করলে অপর প্রান্ত হতে যে আওয়াজ পাই তাহলো, চাচা, আমি মির্জা খবির (ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক) হাওয়া ভবন থেকে বলছি। ম্যাডাম আমাকে ডেকে এনে বলেছেন যে আহমেদ আলী সাহেবতো জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দেননি। আমার ডাকে সাড়া দিলে স্পীকার করা হবে। উত্তরে বললাম, জুমার নামাজ আদায় করে এসেছি মাত্র। পেটে ক্ষুধা। তাই এক কথায় বলি যে জিয়ার বেলায় সোজা ‘নো’ বলেছিলাম। কিন্তু ম্যাডামের বেলায় তা না বলে বিবেচনা করে পরে জানাবো বলেই রিসিভারটি রাখার সাথে সাথে স্ত্রীর জিজ্ঞেসা, ব্যাপারটা কি? উত্তরে বললাম নিজের হাতে গড়া আওয়ামীলীগের মনোনয়নই পাচ্ছিনা। অথচ জিয়্ াদম্পতির সাথে আমার সামান্য দিনের পরিচয়। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা উত্তর কালে আমি যখন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার প্রশাসনের দায়িত্বরত তখন কর্নেল জিয়া ময়নামতি সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে কুমিল্লায় আসেন। যৌথ বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার বাকসী তখন প্রতিদিন সকাল বেলায় আমার বাসায় এসে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসতেন। সে সুবাদে কর্নেল জিয়াও প্রায় প্রতিদিন আমার বাসায় আসতেন। বললাম যে সেই সামান্য পরিচয়ের সূত্রেই বেগম জিয়া আমাকে স্পীকার বানাতে প্রস্তাব দিয়েছেন। একথা শুনে আমার স্ত্রী সাথে সাথে বলে ওঠে, আল্লাহর দোহাই। এটা করা যাবেনা। অতঃপর বলতে থাকে, বঙ্গবন্ধু যতোবার এসেছেন ততোবার যাবার বেলায় আমার মাথায় হাত বুলায়ে বলতেন, বোন তোমাকে যতো কষ্ট দেই তার শতভাগের এক ভাগও নিজের বোনদের দেবার সুযোগ পাইনা। তাঁর হাতের ছোঁয়া এখনো প্রতিনিয়ত অনুভব করি। তারপর বলে যে তুমি জান আমার পিতা একজন বাঘা পুরুষ এবং জেলা মুসলীমলীগের সভাপতি ছিলেন। এতদসত্ত্বেও আমি আম্মাসহ ভাই বোনদের আওয়ামীলীগ বানিয়েছি। বললাম- আমিতো চলে যাইনি। বিবেচনার কথা বলেছি মাত্র। আর তাতেই আল্লাহর দোহাই দিয়ে ফেলেছ। সুতরাং তোমার বাঁধাই মেনে নিলাম বলেই রিং ব্যাক করে মির্জা খবিরকে আমার অপরাগতার কথা জানিয়ে দেই। এখানে উল্লেখ করতে দ্বিধা নেই যে, এ সঙ্গে আমার একটা ভুল ধারনারও অবসান ঘটে। তা হলো বঙ্গবন্ধু যখন নাজিরা বাজারে পাকা দেওয়ালের টিনের ঘরে ঢাকায় পারিবারিক জীবন শুরু করেন, তখন আমি পাশের গলি আলু বাজারে বোনের বাসায় থাকতাম। ছিলাম ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি। ফলে সকাল-বিকাল ছিলো আসা যাওয়া। সেদিন যেই চঞ্চল মেয়েটিকে দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করতে দেখেছি, সেই শেখ হাসিনা আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। অপরদিকে বেগম মুজিব অজপাড়াগাঁ থেকে এসে খুবই সহজ সরল এবং লাজুক ছিলেন। প্রথমটায় আমাদের সামনেই আসতেন না। অল্পদিন পরই তার অবসান ঘটে। পান খেয়ে ঠোট লাল করে রাখতেন। মাঝে মধ্যে ঠাট্টাস্থলে যখন বলতাম, ভাবী আজ বোধ হয় পান কম খেয়েছেন। তাই ঠোটটা কম লাল তখন ধমক দিয়ে ভেতরে চলে যেতেন। সেদিনের ধারণায় যখন বিশ্বখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিতে বেগম মুজিবের অবদান ছিলো বলে শুনতাম, তখন এটাকে চাটুকারি মনে হতো। এখানে বলতে দ্বিধা নেই; আমার স্ত্রী জেলা শহরে জন্ম এবং বর্ধিত। অপরদিকে আমি অজপাড়া গাঁয়ের কৃষক সন্তান। এতদসত্বেও আমার রাজনীতিতে তার অস্তিত্বই অনুভব করিনি। কিন্তু এই ঘটনার পর তার অস্তিত্বই শুধু নয়; তার বিরাট ভূমিকারও প্রমান পেলাম। ফলে বেগম মুজিবের বেলায় যে ভুল ধারণা ছিলো তার অবসান ঘটে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা থাকাকালে কুমিল্লায় একটা কর্মসূচি শেষে ঢাকা যাবার পথে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরীসহ আমার বাসায় এসেছিলেন। তখন আমার স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর এখানকার কাহিনী যখন অশ্র“ সজল নয়নে বলছিলো, তখন তিন জনই আবেগ আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। বিগত ২০ জানুয়ারি আমার স্ত্রীর মৃত্যুর সাথে সাথেই এ খবরটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছানোর জন্য সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুকে অনুরোধ করি। আবদুল মতিন খসরু খবরটি পৌঁছানোর সাথে সাথে মহামান্য রাষ্ট্রপতিসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শোক বাণী পাঠিয়ে আমাকে চিরকৃতজ্ঞ করেছেন।
লেখক ঃ প্রবীণ আইনজীবী ও রাজনীতিক, কুমিল্লা।
