শহিদুল ইসলাম হিরা, শেরপুর : আজ ২৩ মার্চ, ১৯৭১ সনের এই দিনে শেরপুর শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্কে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা ওড়ানো হয়। পরবর্তীতে ৭ ডিসেম্বর এই পৌর পার্কে ভারতের তৎকালীন সেনা প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকাপ্টারযোগে নেমে শেরপুরকে মুক্ত ঘোষনা করেন। তবে ২৩ মার্চ এই পৌরপার্ক মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সময় শত শত প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার মুহুর্মুহু শ্লোগানের মধ্য দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত ‘জয়বাংলা’ লেখা সাদা রঙের ওই পতাকা উত্তোলন করেন। অপরদিকে ঘাতক রাজাকার খ্যাত বর্তমান ফাসিঁর রায় দন্ড নিয়ে কারাগারে আটক জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান সংগঠিত করতে থাকেন রাজাকার বাহিনী।
পতাকা উত্তোলনের এ অগ্রনায়করা হলেন, তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা আমজাদ হোসেন, মোজাম্মেল হক, ফকির আক্তারুজ্জামান, আব্দুল ওয়াদুদ অদু, লুৎফর রহমান মোহন প্রমূখ।
এখনও ওই পতাকাটি বর্তমান সেক্টার কমান্ডার্স ফোরামের সদস্য সচিব ফকির আক্তারুজ্জামানের কাছে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে। তখন শেরপুরের সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বাংলাদেশের পতাকা কেমন হবে তা নিশ্চিত না হলেও স্থানীয়ভাবে নিজেরা ধারনা করেই ওই পতাকাটি তৈরী করেন।
১৯৭১ সনের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষনটি ৮ মার্চ রেডিও’র মাধ্যমে শোনার পর থেকেই শেরপুরের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা আরো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সভা-সমাবেশ, মিছিলে-মিটিংয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো শেরপুর এলাকা। চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। এ সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা হলেন, প্রাক্তন এমএনএ এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান, প্রয়াত নিজাম উদ্দিন আহম্মদ, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান প্রয়াত এ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ, বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা প্রয়াত বিপ্লবী রবি নিয়োগী, প্রবীন শিক্ষাবিদ মো. মুহসীন আলী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান ও ভাষা সৈনিক প্রয়াত খন্দকার মজিবর রহমান, প্রয়াত এমদাদুল হক হীরা, ভাষা সৈনিক আব্দুর রশিদ প্রমূখ।
সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় বর্তমান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (সার্বিক) বাসভবনটি। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের প্রথম সমাবেশেই বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পাকিস্থানি ষড়যন্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহŸান জানানো হয়। এই সমাবেশেই আড়াইআনি বাড়ির মুক্ত আম্রকাননে (বর্তমান সরাকারী মহিলা কলেজ) স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে প্রাথমিক প্রশিক্ষন প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এসময় তৎকালীন থানা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রয়াত গোলাম মোস্তফা দুদুর ওপর অর্পিত হয় প্রশিক্ষন শিবিরের দায়িত্ব। শেরপুর থানা থেকে সংগৃহীত কয়েকটি বন্দুক দিয়ে এখানে শত শত ছাত্র-যুবককে প্রশিক্ষন দেয়া হয়। এরপর ১ এপ্রিল ভারত সীমান্ত ঘেষা ঝিনাইগাতী থানার রাংটিয়া পাতার ক্যাম্পে স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষন শিবির। শেরপুরের ১১ জন যুবক এ প্রশিক্ষন শিবিরে প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন তারা হলেন, আব্দুল ওয়াদুদ অদু, মোকছেদুর রহমান হিমু, প্রয়াত এমদাদুল হক নিলু, তালাপতুফ হোসেন মঞ্জু, প্রয়াত হাবিবুর রহমান ফনু, ফরিদুর রহমান ফরিদ, হযরত আলী হজু, কর্নেল আরিফ, ইয়াকুব আলী, আশরাফ আলী ও মমিনুল হক বেলাল।
শেরপুরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত ও ট্রেনিং নিতে থাকে এদিকে তখন বর্তমানে মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসির রায়ে দন্ড প্রাপ্ত কারাবন্দি জামায়াত নেতা এবং তৎকালের বৃহত্তোর ময়মনসিংহ জেলার ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান কামারুজ্জামনের নেতৃত্বে শেরপুরে ইসলামী ছাত্র সংঘের সেক্রেটারী কামরানসহ অনেক রাজাকার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ শুরু করেন বলে জানালেন বর্তমান সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরামের সদস্য সচিব, জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযুদ্ধা এ্যাডভোকেট ফকির আক্তারুজ্জামান।
এক সময় এ দিনটি শেরপুরে পতাকা উত্তোলন দিবস হিসেবে পালন করলেও এখন তা পালন করা হয়না।