জাহাঙ্গীর আলম, চাটমোহর (পাবনা) : বাংলা ঋতুর রুদ্র চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহের চলনবিলে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার তিন দিনব্যাপী হয়রত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহঃ) ওরশ শুরু হয়েছে। চাটমোহর উপজেলা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে নওগাঁয় মুঘল আমলে সদর আমিন কোর্ট। সেখানে একজন সুবেদার ও কাজী থাকতেন। শাহান শাহে আকবর এর রাজ্যত্বকালে নওগাঁয় রাজা মানসিংহ ভ্রাতা ভানসিংহের বাড়ী ও জমিদারী ছিল। হিন্দু সম্পদায়ের তীর্থস্থান ছিল নওগাঁ। হতো করতোয়া নদীতে গঙ্গাঁস্নান বিজয় দশমীর বসতো দুপুরে মেলা’। রাধাবিনোদ মূর্তির মন্দির ছিল। রানীগঞ্জহাট (রানীরহাট) ও রঙ্গমহলপাড়ায় ভাণসিংহের রাজবাড়ী এখনো সেই স্মৃতি বহন করছে। ৯৩২ হিজরীতে নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ’র আমলের একটি মসজিদ রয়েছে নওগাঁয়। এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির ৪ কোনে রয়েছে ছোট ৪ গম্বুজ। এই মসজিদ প্রাঙ্গনেই শায়িত আছেন পীর শরীফ জিন্দানী (রহঃ)। তাঁর মাজারটি ৯ ফুট দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা ৬ ফুট। তখন রাজাদের আমল। ধর্মীয় কুপমুন্ডুতার শেষ ছিলো না। প্রজা নিগ্রহেরও ছিলো না তুলনা। সত্য ও ন্যায় ছিল অন্ধকারে নিমর্জ্জিত। ঠিক এ রকম একটি কুপমুন্ডুক সময়েই ইরানের জিন্দান শহর থেকে কিছু অনুগামী নিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আসেন হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহঃ)। তাঁর পুরো নাম- হযরত আবদুল আলী বাকী শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহঃ)। ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। তখন দিল্লির অধিশ্বর সুলতান নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ। এ সময়ই তিনি তখনকার বৃহত্তর পাবনার জেলার মহাভারতের নদী করতোয়া তীরের তাড়াশের প্রচীন এক বধিষ্ণু গ্রাম নওগাঁ পর্দাপন করেন। পাঠান আমলে গ্রামটির নাম ছিলো নবগ্রাম। পাঠান সুলতানরা এলাকায় বহু দিঘী, পুকুর ও জলাশয় খনন করেন। বর্তমানের নওগাঁয় এখনো সেসব দেখে অতীত সমৃদ্ধির প্রমাণ দেয়। এখানে সুলতান নসরত শাহের আমলের শাহী মসজিদ (মামার মসজিদ), তার দক্ষিন-পশ্চিমে একটু দূরে ‘ভাগ্নের মসজিদ’ এর ধ্বংসাবশেষ এবং শাহী মসজিদ চত্ত¡রে হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহঃ) মাজার শরীফ অবস্থিত। পাক আমলে হতো শুক্রবার থেকে রোববার। সে সময় সুদূর বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, দার্জিলিং থেকে মানুষ ওরসে আসতেন। এখনো সেখানে এ উপলক্ষে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে শুক্রবার জুম্মার নামাজে। এই ওরস উপলক্ষে সেখানে আয়োজন করা হয় ইসলামী জালসার। দেশের বড়বড় আলেমরা সেখানে আসেন ওয়াজ করতে। রাখাল দাস রচিত বাঙ্গালার ইতিহাস ও রাধারমন সাহা বিএল রচিত পাবনা জিলার ইতিহাস গ্রন্থ উল্লেখ করে, অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ তার চলনবিলের ইতিকথায় লিখেছেন-বাগদাদের জিন্দান শহরের জন্ম নেয়া শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহঃ) ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলায় ইসলাম প্রচারার্থে আগমনকারী দরবেশদের অন্যতম ছিলেন। প্রবাদ আছে তিনি বাঘের পিঠে সোয়ার হয়ে এসেছিলেন। চলনবিলের যেখানে এসে তিনি পৌছান সেটা ছিল রাজা মানসিংহের ভ্রাতা ভানসিংহের বাড়ীর সীমানা। এ সময় সেখানে কিছু ব্রাহ্মন কালিমূর্তিতে ভোগ দিচ্ছিলেন। পীর সাহেব তাদের কাছে জানতে চান-তোমাদের প্রতিমা খায় না কেন ? উত্তরে অবাক ব্রাহ্মনরা জানায়-প্রস্তুরমূর্তি কি খেতে পারে ? পীর তাদের বলেন, আমি খাওয়াতে পারি, দেখবে। তখন পীর মূর্তিকে খেতে আদেশ করলে, কালিমূর্তি খেতে শুরু করে। পীরের এই অলৌকিক মজেজায় বিমুগ্ধ হয়ে কতকজন ব্রাহ্মণ ইসলাম গ্রহণ করেন। বাঁকীরা রাজা ভানসিংহকে গিয়ে ঘটনা জানান। রাজা দরবেশকে ধরতে সৈন্যদল পাঠান। তারাও এসে দরবেশের কাছে ধর্মান্তারিত হন। খবর পেয়ে ধর্ম হারানোর ভয়ে ভানসিংহ পলিয়ে গিয়ে সপরিবারে ‘খিড়কী পুকুরে’ ডুবে মরেন। কথিত আছে পাঠশালায় থাকা দুই ছেলে পরে ফিরে এসে দরবেশের কাছে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে তারা পীরকে ১ হাজার বিঘা লাখেরাজ জমি দান করে। পীর শরীফ জিন্দানী ভানসিংহের কালি মন্দিরের উপর মসজিদ নির্মান করেন। অদ্যাবধি ভানসিংহের ভিটা, রাজপুরীর চারদিকের পরিখা, সেই খিড়কী পুকুর বিদ্যমান রয়েছে। হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রহঃ) এর সাথে সে সময় শাহ্ শরীফ খান্দানী, শাহ্ কালু ও শাহ্ আফ্জাল বোখারী নামের কতকজন দরবেশ এখানে বসতি স্থাপন করেন। কিছুকাল পরে শাহ্ কালু ও আফজাল বোখারী শাহ্জাদপুরের নরিনায় ইসলাম প্রচারে গমন করেন। হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানীকে (রহঃ) ঘিরে রয়েছে অনেক গল্প-কল্প কাহিনী। কথিত গুলো এখনো চাউড় রয়েছে। তাকে একজন জিন্দা পীর হিসাবে ভক্তরা ভেবে থাকেন। ১৩৫৪ সালে উধুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও আগ্দীঘল মাদ্রাসার সেক্রেটারী মৌলবী তোফাজ্জল হোসেন খোন্দকার নওগাঁ ওরস পরিাচলনা কমিটির প্রথম সেক্রেটারী ছিলেন। চাটমোহর পৌরসভার কাজীপাড়া মহল্লার বাসিন্দা নওগাঁ ডিগ্রী কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক কাজী আব্দুস সালাম মাসুদ জানান, ওরশের ৩ দিন মানুষের সমাগমে মুখরিত হয়ে ওঠে চলনবিলের এই জনপদটি। কয়েক মাইল দূর থেকে সে শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। দেশের বহু দূর-দূরান্তের মানুষ আসেন এখানে। তবে নাম প্রকাশ না করে ওই এলাকার কিছু মানুষ অভিযোগ করেন যে, পীরের মাজার পরিচালনাকারীরা অর্থের লোভের কারনে ওরশ চলাকালে সেখানে শরিয়ত বিরোধী অনেক কার্যকলাপ চললেও বাঁধা দেওয়া হয় না। তারা গঞ্জিকাসেবী ভক্তদের বেলিলাপনা, বউমেলাকেও পীরের আদর্শ বিরোধী বলে দাবী করে এ সব বন্ধের দাবী করেন প্রশাসনের কাছে।