কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : ‘মানবতার ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করতে অসাম্প্রদায়িক সাম্যের সমাজ চেয়েছিলেন বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ। তিনি শিখিয়েছিলেন-ধর্মের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সম্প্রীতি বজায় রাখা যায় না। সব ধর্মের ওপর মানব ধর্ম।’
শনিবার রাতে কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে লালন স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ সদর আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফ।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ও লালন একাডেমি ৫ দিনব্যাপী এ উৎসবের আয়োজন করে।
তিনি বলেন, আমাদের এই আয়না মহলে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই আরশীনগরের পড়শী। তিনি আমাদের অতি নিকটের আত্মার আত্মীয় ও পরম বন্ধু। তিনি সমাজের ধর্মান্ধ গোড়ামী শাসকদের পক্ষপাত বিচার বৈষম্য দূর করতে ফকির লালন সাঁই তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে গ্রহণযোগ্য জাতপাতহীন সমাজ ব্যবস্থার দিক দর্শন দেখিয়েছেন। ফকির লালন সাঁই একাডেমিক শিক্ষিত না হলেও আধ্যাত্মিক জগতের স্ব-শিক্ষিত মানুষ ছিলেন তিনি। সেদিন সকল ধর্মের উর্ধ্বে থেকে মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই মানব মুক্তির জন্য সৃষ্টি করেছিলেন ফকিরী মতবাদ।
সভাপতির বক্তব্যে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, বাউল সম্রাট লালন শাহ সব ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সদা সত্য পথে চলতে মানুষকে মানবতাবাদীর পথে ডাক দিয়েছিলেন। তিনি অহিংস মানবতার ব্রত নিয়ে দেহতত্ব, ভাবতত্ব, গুরুতত্বসহ অসংখ্য গান সৃষ্টি করে গেছেন। তার সঙ্গীত কোনো ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।’তিনি আরও বলেন
খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, পাখি কমনে আসে যায় এই গানটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাংঘাতিকভাবে নাড়া দিয়েছিল। সাঁইজির সহজিয়া ফকিরী মতবাদের জাতহীন মানব দর্শন ও সঙ্গীত দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বাঙ্গনে। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র অমরত্বের জন্যই কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া এখন বিশ্ব মরমীর তীর্থ কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, লালনের মানবমুক্তির আলোকিত সৃষ্টি বাউল গান নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা আজ সত্যিই প্রসংশা ও খ্যাতির শিখরে পৌছেছে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের লেখনীর মাধ্যমে তাঁকে সারা বিশ্বের ভক্ত ও অনুরাগী মানুষ লালনকে চিনেন, জানেন ও হৃদয়ে লালন করবেন চিরদিন। তিনি বলেন, লালনের এই আখড়াবাড়ীতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসে আর বছরে দুইবার লাখো লাখো মানুষের সমাগম ঘটে।
একদিন বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইকে নিয়ে অনুষ্ঠিত স্মরণোৎসব কুষ্টিয়ার এই আখড়াবাড়ী ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাবে এবং তাঁর স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আজগর আলী তার বক্তব্যে বলেন, লালনকে আজও জানা হলো না। তাকে যতবার জানতে চাই, জানতে যায় মনে হয় তিনি অনেক গভীরে। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ বাঙালী সংস্কৃতির এক মহান প্রতিনিধি। বাংলা সংস্কৃতির মূল ধারা লোকসংস্কৃতি। এই ধারাকে যারা পুষ্ট করেছে ফকির লালন তাদেরই একজন। সম্প্রদায় সম্প্রীতি ও ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ফকিরীবাদ বাউলতত্ব মানুষের প্রধান দর্শন। লালন ধর্মবর্ন নির্বিশেষে সকল মানুষের আশ্রয়স্থল তৈরী করে রেখেছেন। লালন ফকির, গানে ও সাধনায় তার দর্শণে সেই মানবিক মূল্যবোধে সেই সামাজিক চেতনায় গভীর, লালন ফকির একই সঙ্গে মরমী এবং দ্রোহী, তার গানের ভেতর দিয়ে বাউল সাধনার নানা প্রসঙ্গ অনুসৃত হয়েছে। তার গানের ভেতর দিয়ে সমাজের অসঙ্গতি, কুপ্রথা সকল জাতপাতের ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। মানুষ ভজন ও বাউল সাধনের সব অনুসঙ্গ লালন তার গানের ভেতর দিয়ে এমন এক ভূবন সৃষ্টি করেছেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই আগত অতিথিদের লালন একাডেমী ও বেসরকারি মোবাইলফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া ও ক্রেষ্ট দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়।
লালন একাডেমীর সভাপতি ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন- কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মফিজউদ্দিন আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসগর আলী, সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম, লালন একাডেমীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাইজাল আলী খান, গ্রামীণফোনের আঞ্চলিক ব্যাবস্থাপক আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।
স্বাগত বক্তব্য দেন, লালন একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক রেজানুর রহমান খান চৌধুরী মুকুল। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন, কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহেলা আক্তার।
লালনের জীবনদর্শন নিয়ে আলোচনা করেন, ঢাকার ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
৫ দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে লালন একাডেমী চত্বরে তিল ঠাঁই ছিল না। কালী নদীর তীরে উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিদিন লালন বিষয়ক আলোচনা, বিভিন্ন শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে লালনগীতি পরিবেশন, আখড়াবাড়িতে লালন মেলা চলবে পাঁচদিন ধরে। মাজারের আয়না মহলে সাধু-ভক্তদের লালনগীতি পরিবেশন চলছে গভীররাত পর্যন্ত।
আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয় লালন সংগীত। এরপর দলীয় লালন সঙ্গীত পরিবেশন করেন লালন একাডেমীর শিল্পীরা।
যেখানে সাঁইর বারামখানা, তিন পাগলে হলো হলো মেলা, সময় গেলে সাধন হবে না, মিলন হবে কতোদিনে এমন বেশ কিছু লালনগীতি গেয়ে দর্শকদের আনন্দে মাতিয়ে রাখেন লালন একাডেমীর শিল্পীরা।
গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই সংগীত পরিবেশন। উৎসবকে ঘিরে পুরো একাডেমি চত্বরে খন্ডখন্ড স্থানে গান পরিবেশনের সময় দর্শক-শ্রোতারাও নেচে-গেয়ে গানে তাল দেয়। দর্শক-শ্রোতারা কখনো পিন-পতন নীরবতায় গান শুনছেন আবার কখনো গানের তালে করতালি দিয়ে মুখর করে তুলছেন আখড়াবাড়ির আঙ্গিনা।
অনুষ্ঠানটি সার্বিক উপস্থাপনা ও পরিচালনা করেন কণ্ঠরাজ কবি শুকদেব সাহা।