দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি : আমার মারে আইনা দাও, কার কাছে যামু আমরা? কি অন্যায় করছিল আমার মা-এভাবেই ঢুকরে কাঁদছিলেন গৃহবধূ শাহিনার অবুঝ সন্তানরা কবর ধরে এভাবেই কাঁদছিল । এসময় অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। শত লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর অমানসিক নির্যাতন সহ্য করার পরও স্বামীর কবল থেকে রেহাই না পাওয়া গৃহবধূ শাহিনার অবুঝ সন্তানরা কবর ধরে এভাবেই কাঁদছিল। স্বামীর ভাড়াটে খুনিদের হাতে নিহত শাহিনার মরদেহ ৬৪ ফুট পাইপের নিচে গুম করা হয়েছিল। স্বামীর সংসার আঁকড়ে ধরার পুরস্কার হিসেবে স্বামীর ভিটাতেই আজ শেষ ঠিকানা হলো গৃহবধূ শাহিনার। অবুঝ তিন সন্তানকে রেখে গেলেন তিনি। শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৫টার দিকে শাহিনার মরদেহ কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ছেচরাপুকুরিয়া গ্রামের স্বামী মোবারক হোসেনের উঠানেই তার লাশ দাফন সম্পন্ন হয়। এসময় ছেচরাপুকুরিয়া গ্রামসহ নিহত শাহিনার বাবার গ্রাম তুলাগঁঁও ও আশপাশের অনেক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ জানাযায় অংশ নেন। পাষন্ড- স্বামী মোবারক হোসেন শাহিনাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে না পেরে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করে গভীর নলকূপের ৬৪ ফুট গভীরতায় ফেলেও গোপন করতে পারলেন না। খুনির স্বীকারোক্তি মোতাবেক গভীর নলকূপের ১৪ইঞ্চি ৮০ ফুট পাইপ উত্তোলন করে ৬৩ ফুট গভীরতা থেকে নিহত গৃহবধূ শাহিনার মরদেহ উদ্ধার করে। পরিবারের সিদ্ধান্তে স্বামীর ভিটাতেই শেষ ঠিকানায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলো শাহিনা। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার শাহিনার মরদেহ উদ্ধার করার পর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে শুক্রবার বিকেলে শাহিনার পৈত্রিক বাড়ি দেবিদ্বার উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে আনা হয়। তিনি বলেন, শাহিনার মরদেহ কোথায় দাফন করা হবে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে পরিবার ও গ্রামবাসীর সাথে পরামর্শ করে শাহিনার স্বামীর ভিটাতে দাফন করা হয়। নিহতের মা রেজিয়া বেগম জানান, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য করেও আমার মেয়ে স্বামীর ঘর ছাড়েনি। তাই তার স্বামীর ভিটাতেই দাফন করতে বলি। আমার বড় নাতি (নিহত শাহিনার ছেলে) ইমরানও তার মাকে ওই বাড়িতে (ইমরানের পৈত্রিক ভিটা) দাফন করতে বলেছে।
নিহতের স্বজনরা জানায়, জেলার দেবিদ্বার উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের তুলাগাঁও গ্রামের কেরামত আলীর মেয়ের সাথে ১২ বছর পূর্বে পাশ্ববর্তী ছেচরাপুকুরিয়া গ্রামের সোলেমান মিয়ার পুত্র দুবাই প্রবাসী মোবারক হোসেনের বিয়ে হয়। তাদের ২ ছেলে ও ১ মেয়ে সন্তান রয়েছে। বিগত প্রায় ২ পূর্বে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। মোবারক ছুটিতে দেশে আসার পর পরিস্থিতি আরো অবনতি ঘটে। প্রায় ৩/৪ মাস ছুটি শেষে মোবারক হোসেন বিদেশে চলে যাওয়ার পরও মোবারক হোসেনের পরিবার শাহিনাকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছিল। এক পর্যায়ে শাহিনা বাদি হয়ে তাদের বিরুদ্ধে দেবিদ্বার থানায় নারী নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেন। মোবারক বিদেশ যাওয়ার পর পরে তাকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। শাহিনা হত্যা মিশনে অংশ নেয় ৩ খুনী। তাকে হত্যা করতে স্বামী মোবারক হোসেনের দেয়া ১লাখ টাকা ভাড়াটিয়া ৩ খুনী ভাগাভাগি করে নেয়। প্রেমের অভিনয় করে ঘর থেকে বের করে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর গৃহবধু শাহিনাকে ৮০ ফুট গভীর নলকূপে নিক্ষেপ করে ঘাতকরা। ৯ মার্চ আদালতে চাঞ্চল্যকর এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে প্রধান ঘাতক আব্দুল করিম। গ্রেফতারকৃত ঘাতক আবদুল করিম পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার পর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ শেষে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ঘাতক আবদুল করিম তার জবানবন্দিতে জানিয়েছে, স্বামী মোবারকের পরামর্শে সে ও আরো ২ ঘাতক শাহিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে মোতাবেক আব্দুল করিমের পার্শ¦বর্তী বাড়ির গৃহবধু শাহিনার সাথে সে প্রেমের অভিনয় করে। এক পর্যায়ে তাকে রাতে বাড়ি থেকে বের করে ঘাতকরা গত ৭ ফেব্রæয়ারি দেবিদ্বারের ধামতী ওরশে নিয়ে যায়। গভীর রাতে ওরশ থেকে ফিরে বাড়ির পাশে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর আব্দুল করিমসহ ওই ঘাতকরা তাকে মাথা নিচে ও পা উপরে রেখে ৮০ ফুট গভীর নলকুপে নিক্ষেপ করে। পরে নলকূপের মুখ মাটি চাপা দেয়। তাকে হত্যার জন্য স্বামী মোবারক হোসেন দুবাই থেকে কুমিল্লার মুরাদনগরে জসিম উদ্দিন নামে তার এক বন্ধুর ব্যাংক একাউন্টে ১লাখ টাকা প্রেরণ করে। প্রধান ঘাতক আবদুল করিম ওই টাকা উত্তোলনের পর শাহিনাকে হত্যা করে সে নিজে ৪০ হাজার টাকা ও অপর দুই ঘাতককে ৩০ হাজার টাকা করে ভাগ করে দেয়। চুক্তি মোতাবেক অবশিষ্ট ১ লাখ টাকা বুঝে পাওয়ার আগে সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।