এম লুৎফর রহমান : স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত আন্দোলন সূচনা হয় রক্তঝরা একাত্তরের পহেলা মার্চ। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন বেতার ভাষণে পূর্ব নির্ধারিত ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার পর ফুঁসে উঠে বাংলাদেশ। বিক্ষোভে উত্তল হয় রাজ পথ। ঢাকা ও নরসিংদীসহ দেশের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ শুরু করে। এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাঙালি যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য ক্ষণ গুনছিল তখন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে ঐ দিন জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করেন। পহেলা মার্চ দুপুর থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।
বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা শ্লোগান তোলে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঢাকা-নরসিংদীসহ সারা দেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কল-কারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে দেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন সারাদেশে তীব্র হয়ে উঠে। সেই থেকে শুরু, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ একটি সার্বিক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
স্বাধীনতা সংগ্রামে নরসিংদীর জনগণ পিছিয়ে থাকেনি। তারা বীরোচিত ভূমিকা রেখে ছিল। দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে ৭১’র সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নরসিংদী জেলার অপামর জনসাধারণ। অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিল তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে। মুক্ত মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৫ শে মার্চের নরসিংদীতে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করে সার্বিক সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় তারা। ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০০ বিদ্রোহী ইপিআর, আনসার এবং পুলিশ নদীপথে নরসিংদীতে পৌঁছেন এবং এরই মাঝে যথাসময়ে রেলপথে পর্যাপ্ত অস্ত্র এবং গোলাবারুদ পোঁছে যায় এবং তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
২রা এপ্রিল পাকবাহিনী নরসিংদী শহর এবং আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। এতে প্রায় ২০০ অসহায় নারী, পুরুষ এবং শিশু মৃত্যুবরণ করে।
কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞ স্বাধীনতা, মুক্তি পাগল নরসিংদীর জনগণকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তারা পাকবাহিনী প্রতিরোধে মরিয়া হয়ে উঠে এবং একটি সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ৪ এপ্রিল রবিবার পাকসেনাদের সাথে বাঙালি ইপিআর ও বাঙালি সৈন্যদের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয় নরসিংদী সদরের মাধবদী রাইনাদীর মধ্যবর্তী স্থানে। এই সংর্ঘষে পাকবাহিনীর ৯টি জীপ ধ্বংস হয় এবং ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও নিহত হয়। ঐ দিন বিকেলে পরাজিত পাকসেনারা পাশ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঢুকে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ও নির্বিচারে বর্বরোচিতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ১৭ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে আব্দুল মান্নান ভূইয়া, আব্দুল মান্নান খান, গয়েছ আলী মাস্টার, সামসুল হুদা বাচ্চু, আলী আকবর, আবুল হোসেন, মনির উদ্দিন, মীর ইমদাদুল হক, ইমাম উদ্দিন, নেভেল সিরাজ ও মোতালিব পাঠান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।