তানোর প্রতিনিধি : আবহমান কাল থেকে বিভিন্ন ভাষা ভাষীর জাতিগোষ্ঠির বসবাস রয়েছে রাজশাহীর তানোর উপজেলায়। বৈচিত্রময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক হিসেবে কেবল এঅঞ্চলের আদিবাসিরাই তাদের সংস্কৃতি ঠিকিয়ে রেখেছেন। এখানে সাংস্কৃতি জোট থাকলেও বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। বিগত ১০ বছর আগে ততকালিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রচেষ্টায় এঅঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের ক্ষুদে কণ্ঠ শিল্পীদের নিয়ে বরেন্দ্র সংগীত একাডেমী গড়ে উঠে। আর্থিক সংকটের কারণে ধীরে ধীরে সেই প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। একারণে তখন থেকে তাদের নেই কোন সংস্কৃতি চর্চা। বর্তমানে হাতেগুনা যে দুয়েকজন কণ্ঠ শিল্পী রয়েছেন তারা শুধু অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি চার্চা করে থাকেন। আবার অনেকে বিভিন্ন রকমের গান গেয়ে সংসার চালান। সংগীত চর্চা ও গান গাওয়াকে অনেকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু এসব শিল্পীদের পাড়া-মহলায় কদর না থাকায় হারাতে বসেছে ক্ষুদে শিল্পীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি।
এনিয়ে কথা হয় তানোর কুঠিপাড়া গ্রামের কণ্ঠ শিল্পী আইয়ূব আলীর সঙ্গে তিনি জানান, বরেন্দ্র সংগীত একাডেমী গড়ে উঠার পর সে সময়ের কণ্ঠ শিল্পীরা ভালই সংগীত চার্চা করত। বর্তমানে সংসার জীবনে অভাবের তাড়নায় তাদের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় দিন কাটচ্ছে। তবুও মনের খোরাক মেটাতে এঅঞ্চলের বিভিন্ন ঘোরয়া ক্লাবগুলো বেছে নিয়ে তার অনুসারী শিল্পীরা সারাদিন মাঠে ঘাটে কাজ করে সন্ধার পরে ক্লাবগুলোতে গিয়ে নিজেদের মনের খোরাক মেটানোর জন্য বিনা পয়সায় গান পরিবেশন করে থাকেন। বর্তমানে তিনি তার নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র দিয়ে বেশ কয়েকটি পাড়া-মহলার ক্ষুদে শিল্পীদের গান শেখান। এই গান শিখিয়ে যা পান তাই দিয়ে তার সংসার চলে। তিনি কোন কাজ করতে পারেন না বলে তার পেশাটি ধরে রেখেছেন। তবে, এদিক থেকে আদিবাসি জনগোষ্ঠীরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন যাত্রায় তাদের ভাষার গান গেয়ে থাকেন বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। তাদের ভাষার সংস্কৃতি ধরে রাখতে আজো ব্রতী নামের একটি বেসরকারী সংস্থা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র দিয়ে তাদের উৎসাহীত করে আসছেন। আদিবাসিদের মত তাদের শিল্প গোষ্ঠীকে সহায়তা করা হলে সংগীত চর্চার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, কোন উস্তাদ ছাড়াই নিজের ইচ্ছায় ভিন্ন ধরণের গান গেয়ে তানোর গ্রামের রাজীব এখন দিন কাটাচ্ছেন। সে বিভিন্ন পাড়া মহলায় ও চায়ের স্টলে গান গেয়ে দর্শকদের মন জয় করে অর্থ আদায় করেন। রাজীবের মত সেই অন্ধ ছেলেটির দিকে কোন হৃদয়বান ব্যক্তি সহায়তা করলে একদিন সে বড় শিল্পী হতে পারতো। তার পাশে সেই অর্থ জোগানোর কেউ নেই বলে পাড়া গাঁয়ে ও চায়ের স্টলে গান গেয়ে কোন রকমে তার সংসার চলে। এঅঞ্চলের মানুষ অবহেলার চোখে শিল্পীদের দেখে বলে এখানকার সাংস্কৃতিক শিল্পীদের নেই কোন মূল্যায়ন।
এনিয়ে উপজেলার কচুয়াকাজীপাড়া আদিবাসী সাংস্কৃতিক দলের সভাপতি নরেন মুর্মূ জানান, এঅঞ্চলের প্রায় ২০টি আদিবাসী সাংস্কৃতিক দলের মধ্যে রয়েছে নিজস্ব হারমোনিয়াম, মাদল, কড়া কড়কা, জুড়ি ঝাই, আড়বাঁশি ও ঝুমকা। তারা তাদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতিনিয়ত সংগীত চর্চা করে থাকেন। তারা তাদের সংগীত চর্চার মাধ্যমে বেঁচে থাকেন। ব্রতী নামের ওই সংস্থার মত সরকারী কিংবা বেসরকারী ভাবে কোন সংস্থা তাদের ভাষার সংগীত চর্চায় এগিয়ে আসলে তারা আধুনিক করে রাখতে পারতেন তাদের সংস্কৃতি।
এনিয়ে কথা হয় উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মাজেদা ইয়াসমীনের সঙ্গে তিনি জানান, সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতীর প্রাণ। কেবল মাত্র সংস্কৃতির মাধ্যমেই প্রত্যেক জাতিকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা যায়। যে জাতির সংস্কৃতি যত বেশি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে তারও ততবেশি সমৃদ্ধ। বিশ্বায়নের যুগে ক্ষুদ্র জাতি সত্বার মানুষ যখন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে হারাতে বসেছে তখন এঅঞ্চলে ব্রতী সেতুবন্ধন প্রকল্পের উদ্যোগ আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে মাইল ফলক হিসেবে কাজ করছে। তিনি এঅঞ্চলে আদিবাসি সংস্কৃতি ঠিকিয়ে রাখতে ও কণ্ঠশিল্পীদের সংগীত চর্চা চালু করতে সরকারের কাছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও শিল্পী গোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তার জন্য লিখবেন বলে জানান।