ইয়ানুর রহমান, যশোর : একে একে ৭টি শিশুর লাশ বেনাপোল বলফিল্ডে সারি সারি রাখা সাদা কাপড়ের মোড়ানো দেখে চোখের জল কেউ রাখতে পারেনি। লাশ গুলো দেখে প্রায় সকলে চোখের দু’কোন একবার হলেও মুচেছে। অনেকে আবার নির্বাক চেয়েছিল সারিবদ্ধ লাশ গুলির দিকে। নিষ্পাপ এ শিশু গুলোর মুখ হয়তো কিছুদিন ভাসবে যানাজায় আসা শোকাহত মানুষের চোখের সামনে। কিন্তু সারাজীবনে কী পূরণ হবে সন্তান হারা ওই শিশুদের বাবা-মায়ের ক্ষতস্থান ? এর উত্তর হয়তো কারো জানা না থাকলেও বেনাপোলের ইতিহাসে চিরদিন থাকবে।
রোববার সকালে নিহতদের বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শুধু মানুষ আর মানুষ। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। তবে সকলের চোখের দু’কোন ভেজা ভেজা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম থাকলেও নেই কোন কোলাহল । যেন রাতের নিস্তব্দতা নেমে এসেছে বেনাপোলের ছোট আঁচড়া, নামাজ গ্রাম ও গাজিপুর গ্রাম জুড়ে। শুধু মানুষ নয় প্রকৃতও অঝর ঝরে কাঁদছে দিন ভর। তাই দিনভর ছিল মেঘাচ্ছন্ন। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি যেন প্রকৃতির কাঁন্না।
৭জন নিহতদের মধ্যে সুরাইয়া ও জেবা খাতুন দুই বোন। ৫ম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া ও ৩য় শ্রেণির ছাত্রী জেবা বেনাপোলের ছোট আঁচড়া গ্রামে নানা বাড়ি থেকে লেখাপড়া করতো। মা হারা এ দু’টি সন্তান একসঙ্গেই চলে গেলো “না ফেরার দেশে” মায়ের কাছে। স্ত্রীর মৃত্যুর আড়াই বছর পর দুই সন্তান হারিয়ে নির্বাক তাদের বাবা সৈয়দ আলী। সুরাইয়া ও জেবা খাতুনের মা আড়াই বছর আগে মরন ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর পর তাদের বাবা সৈয়দ আলী অনেকটা সৃতি হারিয়ে ফেলে। তার পর থেকে সুরাইয়া ও জেবা আমাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করতো।
নিহত দুই সহোদরের নানী নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘পিকনিকে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছে, নানু যাচ্ছি, দোয়া করবেন। এই যাওয়া যে শেষ যাওয়া হবে তা জানতে পারলে তাদের কি যেতে দিতাম।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী নিহত মিথিলার (১০) বাবা ছোট আচড়া গ্রামের ইউনুস আলী বলেন, মিথিলা ছিল বাড়ির সকলের চোখের মণি । তাকে সকলে আদরে আদরে রাখতো। সকলের চোখের মনি আজ চলে গেল। বলে চিৎকার করে কেঁদে ফেলল তিনি।
শুধু এ দুটি পরিবার নয় আরো পাঁচটি পরিবারের সাথে চললে সমগ্র এলাকায় শোকের মাতম। দপুর ২টায় বেনাপোল বলফিল্ডে নিহত ৭ শিশুর দু’টি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ২০ সহস্রাধিক মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে নিজ নিজ গ্রামে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। দাফন সম্পন্ন হলেও গোটা এলাকায় শোকের মাতম রয়ে গেছে।
স্বজনদের আহাজারি আর স্থানীয়দের চোখের জলে ভারী হয়ে উঠেছে গোটা এলাকার পরিবেশ। স্বজনহারা পরিবার গুলোতে থেমে থেমে উঠছে কান্নার রোল। মাঝে মাঝে নেমে আসছে গভির রাতের নিস্তব্ধতা।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে যশোরের চৌগাছার-মহেশপুর সড়কের ঝাউতলা এলাকায় শিক্ষা সফরের বাস (রাজশাহী মেট্রো-জ- ১১-০০৮০) রাস্তার পাশে খাদে পড়ে গেলে ঘটনাস্থলেই ৭ শিশু শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তবে একজন শিশু নিখোঁজ থাকলেও রবিবার দুপুরে ৭শিশুর নামাজে যানাজার সময় চৌগাছার এক হৃদয়বান ব্যক্তি তাকে নিয়ে হাজির হয়। এ দুর্ঘটনায় আহত হয় আরও ৪৬ জন।
নিহতরা হলো, বেনাপোলের ছোট আচড়া গ্রামের সৈয়দ আলীর দুই মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া (১০) ও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী জেবা আক্তার (৮), ইউনুস আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মিথিলা (১০), রফিকুল ইসলামের মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রুনা আক্তার মীম (৯), লোকমান হোসেনের ছেলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শান্ত (৯), গাজিপুর গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাব্বির হোসেন (১০), নামাজ গ্রামের হাসান আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী আঁখি (১১)।
নিহতদের স্মরণে শার্শা উপজেলায় এক দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বেনাপোল পৌর সভার পক্ষ থেকে ৩ দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোল ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
এ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাবিনা ইয়াসমিনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে, এ দুর্ঘটনার খবর পৌঁছালে শনিবার রাত থেকেই গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠীসহ এলাকাবাসীর চোখের জলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
রোববার সকাল থেকেই সর্বস্তরের মানুষ নিহতদের এক নজর দেখার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমাবেত হয়। হাজারো মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানায় সোনামুখগুলোর। আহাজারি আর নানা স্মৃতির কথা বলতে বলতে স্বজন, শিক্ষার্থী আর পাড়া প্রতিবেশিরা বিলাপ করছেন।
অন্যদিকে, নিহতদের পরিবারে সান্ত্বনা দিতে বাড়িতে ছুটে যান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপারিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ, জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সুব্রত কুমার বণিক, উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মিন্নু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম শরীফুল আলম, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার অহিদুল ইসাম প্রমুখ।