মো. গোলাম রব্বানী, পাইকগাছা (খুলনা) : খুলনার পাইকগাছার উৎপাদিত চিংড়ি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি উপকূলীয় এ জনপদের সাধারণ মানুষের। বছরের পর বছর ধরে অধিকাংশ বৃহৎ আয়তনের চিংড়ি ঘেরগুলো প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় এক দিকে ধনী হয়েছে গুটি কয়েক লোক। অপরদিকে জমির মালিক হয়েও ভূমিহীন রয়েছে হাজার হাজার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জমির মালিকগণ। চাষাবাদ করতে না পারায় অভাবের তাড়না ও দ্বায়-দেনার ভারে ইতোমধ্যে অনেক পরিবার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। অনেকেই এলাকায় পড়ে থাকলেও পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা চূড়ান্ত ও বাস্তবায়ন করা জরুরী বলে মনে করছে অভিজ্ঞমহল।
সূত্র মতে, কৃষি সমৃদ্ধ এ অঞ্চলে ৮০’র দশকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু হয় লবণ পানির চিংড়ি চাষ। অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অধিক লাভজনক হওয়ায় কয়েক বছরের মধ্যে চিংড়ি চাষ ছড়িয়ে পড়ে গোটা উপজেলায়। উপজেলা কৃষি অফিসের সূত্র মতে, উপজেলায় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ৩০ হাজার হেক্টর। যার মধ্যে চিংড়ি চাষ হয় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে। মৎস্য অফিসের সূত্র মতে, প্রতি বছর এ উপজেলা থেকে ৮-১০ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি, কাঁকড়া ও অন্যান্য মাছ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ সব উৎপাদিত মৎস্য সম্পদ জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। ধান-মাছ পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি আজমল হোসেন বলেন, সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়ার অন্যতম কারণ অধিকাংশ চিংড়ি ঘের প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা। তার মতে, এমন অনেক প্রভাবশালী ঘের মালিক আছেন যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে হাজার হাজার বিঘা আয়তনের কয়েকটি চিংড়ি ঘের। এ ধরণের বৃহৎ আয়তনের অসংখ্য চিংড়ি ঘের প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় প্রকৃত জমির মালিকরা না পারছে ধান চাষ করতে, না পারছে মাছ চাষ করতে। ফলে কর্মসংস্থানের অভাবে ঘের মালিকের দেওয়া সামান্য হারীর টাকা বছরের শুরুতেই চলে যাচ্ছে বাজার খরচে। বান্দিকাটি গ্রামের আহম্মদ আলী সরদার জানান, নিজের জমি থাকতেও আজ সে ভূমিহীন। নিজের জমি প্রভাবশালীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় বৃদ্ধ বয়সে ভ্যান চালিয়ে তাকে সংসার চালাতে হয় বলে তিনি জানান। ধার-দেনা করে সারা বছরের সংসার খরচ যোগাতে গিয়ে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত লোকেরা। অভাব-অনাটন ও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে একটা সময় এসে ঐ ঘের মালিকের নিকট জমি টুকু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকেই। এভাবেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে এলাকায় ভূমিহীনের সংখ্যা। একটা সময় ঘেরের মেয়াদ শেষান্তে স্থানীয় জমির মালিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের জমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে প্রভাবশালী ঘের মালিকরা হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানী করার কারণে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় এলাকাবাসীকে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনও প্রভাবশালীদের মোটা অংকের টাকার কাছে আত্মসমার্পন করার কারণে প্রশাসনিক সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উপজেলার লতা ইউনিয়নের তেতুলতলা, মাঝেরাবাদ ও গঙ্গারকোণা মৌজার হাজার হাজার বিঘা চিংড়ি ঘের দীর্ঘদিন ধরে জুয়েল ফিস নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। এক্ষেত্রে এলাকাবাসী নিজেদের জমির দখল বুঝে নেয়ার চেষ্টা করলে প্রভাবশালী ঘের মালিক অসংখ্য হামলা ও মামলা দিয়ে এলাকাবাসীকে হয়রানী করে। দীর্ঘদিন ধরে এ বিরোধ চলে আসার কারণে অনেকেই ভিটে ছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে এলাবাসাী জানান। সর্বশেষ প্রভাবশালী ঘের মালিক রফিকুল ইসলামের দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে থাকা পানা মৌজার ৪৫০ বিঘা চিংড়ি ঘেরের মেয়াদ ২০১৩ সালে উত্তীর্ণ হওয়ায় এলাকাবাসী উক্ত ঘেরের মধ্য থেকে চলতি বছরের শুরুতেই বসতবাড়ী সংলগ্ন ১৫০ বিঘা সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিলে প্রভাবশালী ঘের মালিক একাধিক মামলা দিয়ে এলাকাবাসীকে হয়রানী করছে বলে স্থানীয় প্রভাষক কুমারেশ জানান। সংঘাত-সংঘর্ষ এড়ানো সহ সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা চূড়ান্ত করা জরুরী বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। উলেখ্য, বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর চিংড়ি ঘেরের সর্বোচ্চ আয়তন ৭০ বিঘার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা প্রক্রিয়া শুরু করলেও অজ্ঞাত কারণে নীতিমালাটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। উপজেলা ধান-মাছ পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি আজমল হোসেন বলেন, চিংড়ি ঘেরের আয়তন ৫০ বিঘার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা চূড়ান্ত করা হলে একদিকে রোগ প্রতিরোধসহ বৃদ্ধি পাবে চিংড়ির উৎপাদন। অপরদিকে ক্ষুদ্ধ, প্রান্তিক ও মাঝারি পর্যায়ের জমির মালিকরা ফিরে পাবে তাদের অধিকার। এতে একদিকে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে, অপরদিকে ধান চাষ করার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে তিনি জানান। সর্বপরি সাধারণ মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে অবিলম্বে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা চূড়ান্ত ও বাস্তবায়ন করা হোক এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।