শামসুর রহমান, কেশবপুর (যশোর) : আধুনিক বাংলা কবিতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান কেশবপুরের সাগরদাঁড়ির মাটি আর কপোতাক্ষ নদের স্মৃতি ছাড়া কবির কোনো স্মৃতি নেই। আছে ভুলে ভরা বাদামতলা, বিদায় ঘাটের গল্পসহ কিংবদন্তি। কবির মৃত্যুর ১৯০ বছর পরও এ গল্পের কোনো কিনারা হয়নি। তারপরও প্রতি বছর মধুমেলা আর কবির স্মৃতিবিজড়িত সাগরদাঁড়ি দেখতে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।

সাগরদাঁড়িতে রয়েছে মধুসুদনের পৈত্রিক বাড়ি, পাঠাগার, মিউজিয়াম, কবির আবক্ষ ভাষ্কর্য, মধু উদ্যান, শিশুপার্ক,পাঠশালা,কাঠবাদামতলা, বিদায় ঘাট, ঐতিহাসিক কপোতাক্ষ নদ, মধুসূদন একাডেমি, পর্যটন হোটেল, জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। তবে সাগরদাঁড়ি গ্রামের দত্ত বাড়ির শান বাঁধানো ঘাটের পুকুর, নয়নাভিরাম আমবাগন, কারুকাজখচিত দত্ত বাড়ির প্রাসাদ সিংহ দরোজা- এসবের কোন স্মৃতি চিহৃ নেই। মধুসুদনের পৈতৃক বাড়ির কিছু অংশ সংষ্কার করে প্রতিষ্ঠা করে হয়েছে মধুসূদন কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্স দেখভাল করে প্রতœতত্ত¡ বিভাগ। কমপ্লেক্সে একটি মিউজিয়াম ও ঠাকুর ঘর রয়েছে। পুরনো হলুদ রঙের দালানের একটি কক্ষে মধুসুদনের মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়েছে খাট, টেবিল, আলনা, কাঠের বাক্স, লোহার বাক্স, টিফিন ক্যারিয়ার। এগুলোকে মধুসুদনের স্মৃতি হিসেবে উলেখ করা হলেও এ নিয়ে বির্তক রয়েছে। মধুসূদন গবেষকদের ভাষ্য হচ্ছে, সংরক্ষিত জিনিসের একটি ও কবির নয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯০ সালের দিকে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা গ্রাম থেকে এসব সংগ্রহ করে মিউজিয়ামে সাজিয়ে রাখেন। এ মিউজিয়ামের সামনে ১৯৮৪ সালে শিল্পী বিমানেশ চন্দ্র কবির একটি আবক্ষ ভাষ্কর্য নিমার্ণ করেন। এখন কবির ভক্তরা ওই ভাষ্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। কপোতাক্ষ নদের তীরেই রয়েছে একটি কাঠবাদামগাছ। সিমেন্ট দিয়ে বাদামগাছ ঘিরে একটি বেদি নির্মাণ করা হয়েছে। কিংবদন্তির গল্প হচ্ছে, কবি এই বাদামতলায় বসে কবিতা লিখেছেন। কিন্তু এ গল্পের কোনা ভিত্তি নেই। এর কারণ হচ্ছে, মাত্র ৯ বছর বয়সে ১৮৩৩ সালে কবি বাবার কর্মস্থল কলকাতা চলে যান। এসময় তিনি কবিতা লেখা শুরু করেননি। কপোতাক্ষের কিনারা ঘেঁসে রয়েছে বিদায় ঘাট। বিদায় ঘাটের গল্প হচ্ছে, খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করে কবি তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটাকে নিয়ে কলকাতা থেকে বজরায় সাগরদাঁড়িতে এলে বাবা রাজনারায়ণ দত্ত তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি। কবি মা জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে না পেরে এ ঘাট থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। এ কারণেই বিদায় ঘাট নির্মাণ করা হয়। মধুসূদন গবেষকদের বক্তব্য হচ্ছে, কবি ১৮৪৩ সালে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করেন। ১৮৪৮ সালে প্রথম তিনি রেবেকা ম্যাকটাভিসকে বিয়ে করেন। হেনরিয়েটা সে সময় কবির স্ত্রী ছিলেন না। উলেখিত সময়ে কবির পরিবার কলকাতা বসবাস করতেন। কাজেই বিদায় ঘাটের গল্পের সত্যতাও প্রশ্নের মুখে। কবিকে ঘিরে আরো নানা গল্প রয়েছে। এসব গল্প সাগরদাঁড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলা হয়, লেখাও হয়। সাগরদাঁড়িতে দত্ত বাড়ির পাশেই স্থানীয় যুবকরা ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করে মধুসূদন একাডেমি। এই একাডেমিতে কবির গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলিলের ফটোকপি রয়েছে। একাডেমি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা মধুসূদন গবেষক খসরু পারভেজ বলেছেন, মিউজিয়ামে সংরক্ষিত জিনিসগুলো কবির নয়। বিদায় ঘাট এবং বাদামতলার গল্পও খুব জোরলো যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না।
