চারঘাট প্রতিনিধিঃ রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় অধিক মুনাফার লোভে প্রতিদিন মিশ্রিত করা হচ্ছে খেজুর গুড়ের সঙ্গে চিনি। এই উপজেলা এক সময় খেজুর গুড়ের জন্য যথেষ্ট সুনাম ছিলো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে চিনি যুক্ত খেজুর গুড়ের রমরমা ভেজাল ব্যবসা।
জানা যায়, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার গাছিরা খেজুরের গুড়ে চিনি ও বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করছে। এসব খেজুরের গুড় জেলার হাট-বাজার গুলোতে বেধুম বিক্রি হচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই। প্রশাসনের তদারকির অভাবে খেজুরের গুড়ে ভেজাল মিশানোর প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ৮৫ শতাংশ গাছিরা খেজুরের গুড়ে ভেজাল দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শীত এলেই খেজুরের গুড়ের পিঠার যেন তুলনাই হয় না। শীতের সকালে মুড়ি আর খেজুরের রস এক সময় ধণী-গরীব গ্রামাঞ্চলের সকল মানুষের সকালের নাস্তার প্রয়োজন অনেকটা মিটাতো। বর্তমানে নিপা ভাইরাস খেজুরের রসে পাওয়ার ফলে এ অঞ্চলের মানুষ খেজুরের রস-মুড়ি খাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। বর্তমানে বেশি মুনাফার আশায় খেজুরে গুড়ে মেশানো হচ্ছে অপরিশোধিত চিনি। আর এই চিনি মেশানোর ফলে খেজুরের গুড় তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আগে খেজুরের গুড়ের কাছাকাছি গেলেই তার একটা ঘ্রাণ পাওয়া যেত কিন্তু ভেজাল মেশানোর ফলে সেই ঘ্রাণ আর পাওয়া যায় না। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন গাছি জানান, বাজারে চিনির দাম খেজুরের গুড়ের তুলনায় কম হওয়ায় আমরা চিনি মিশাই। এবং চিনির সঙ্গে কিছু পানি দিয়ে জাল দিলে তা পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ফলে বর্তমানে এলাকার প্রায় সব গাছিরা এ কাজ করে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক কেজি খেজুরের গুড়ের মধ্যে প্রায় পাঁচ কেজি চিনি মেশানো হচ্ছে। বাজারের প্রতি কেজি চিনির দাম ৪০-৪২ টাকা। প্রতি কেজি খেজুরের গুড়ের বর্তমান বাজারমূল্য ৪৫ টাকা থেকে ৫৫ টাকা। চিনির মূল্য বাজারে খেজুরের গুড়ের থেকে কম থাকায় গাছিরা চিনি মেশাচ্ছে। বাংলার অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু করে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ অঞ্চলে খেজুর গুড় উৎপাদন করে গাছিরা। এ অঞ্চলে শীতের সকালে প্রতিটি ঘরে পিঠা-পুলি পায়েস তৈরির ধুম পড়ে যায়। মুড়ি, চিড়া, পিঠা খাওয়া কৃষক পরিবার থেকে শুরু করে সবার কাছে বেশ প্রিয়। আর এর মূলে রয়েছে খেজুরের গুড়। এখন এই গুড়ে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। এই ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরিতে এলাকার গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপজেলার বাজারগুলোতে খেজুরের গুড় বিক্রি করতে আশা একজন গাছি জানান, খেজুরের গুড় তৈরি করতে আমাদের খেয়াল রাখতে হয়, যাতে গুড় নরম না হয় এবং রং যেন উজ্জ্বল হয়। সে জন্য আমারা বিভিন্ন ধরনের মেডিসিন ব্যবহার করি। গুড়ে চিনি মেশানোর কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই গুড়ে চিনি মেশায়। তাতে আমাদের বাড়তি আয় হচ্ছে পাশাপাশি গুড়ও দেখতে শক্ত ও রং উজ্জ্বল হয়। গতকাল উপজেলার নন্দনগাছী হাটে গিয়ে দেখা গেছে, যেসব গুড়ের রং উজ্জ্বল এবং শক্ত সেই গুড়ের চাহিদা বেশি। আর একটু নরম ও লালচে রং হলে সেই গুড় বাজার দরের চেয়ে ৮ থেকে ১০ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। হায়দার আলী নামের একজন পাইকাড়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারের উজ্জ্বল রং ও শক্ত টাইপের খেজুরের গুড়ে চাহিদা রয়েছে তাই আমরা এ ধরনের গুড় ক্রয় করি। এখানে সারা বছর একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিদিন কয়েক মন ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি করে। ভেজাল গুড় তৈরির জন্য এই এলাকার ব্যবসায়ীরা তাদের বাড়িতে চিনি মজুদ রাখে। ওই সব ভেজাল গুড়ের কারখানায় বাজারের কম দামের খেজুর গুড় সংগ্রহ করে এতে চারগুন পরিমাণ চিনি মিশিয়ে এবং বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও রং দিয়ে তৈরি হচ্ছে খেজুরের ভেজাল গুড়। ভেজাল গুড়ের কারখানা বন্ধের জন্য এলাকাবাসী প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। এসব ভেজাল খেজুরের গুড় হরহামেশা বিক্রি করা হচ্ছে এলাকার বিভিন্ন হাটবাজারে। এসব গুড় দেখে বুঝার উপায় নেই যে, এগুলো আসলেও ভেজাল গুড়। ভেজাল গুড় বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে উজ্জ্বল রং তৈরি করা হয় এবং চিনি মেশানোর ফলে গুড় শক্ত হয়। আর এই গুড়ের রয়েছে বেশ কদর। ফলে সহজেই পাইকাড়রা এসব গুড় কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে থাকে। এসব ভেজাল গুড়ের ব্যবসা করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। এলাকার সচেতন মহল এসব ভেজাল গুড়ের কারখানা বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।