গফরগাঁও প্রতিনিধি : ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মশাখালী ইউনিয়নের শীলা ব্রীজ ও শীলা বাজারের সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের মনুহরপুর গ্রামের আবু বক্কর, গফরগাঁও উপজেলার মশাখালী গ্রামের আব্দুল আওয়াল জানু, দরি চাইর বাড়িয়া গ্রামের মজনু মিয়া, মুখী গ্রামের আবুল হোসেন ও চাঁন মিয়া । সহযোদ্ধারা সেদিন চোখের জলে গণ কবর খুঁড়ে তাদের সমাহিত করে বীর বিক্রমে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে রুখে দাড়ায়।
স্বরনীয় এ যুদ্ধে সম্মুখ সমরে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ও মশাখালী ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম আহাম্মেদ স্মৃতি হাতরে বলেন, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢালু ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং এর নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল উপজেলার প্রসাদপুর গ্রামের ওমর আলী তালুকদারের বাড়িতে অবস্থান নেয়।
মশাখালী-কাওরাইদ রেলষ্টেশনের মধ্যবর্তী হাওয়াখালী রেলব্রীজ প¬াষ্টিক এক্সপ্লোসিভ এর মাধ্যমে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় মান্নান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর আমরা শীলা বাজার সংলগ্ন শীলা ব্রীজের দখল নেই। ৫ অক্টোবর সকাল ১০ টার দিকে ৬০/৭০ জনের পাক হানাদার বাহিনী শীলা নদীর পূর্বপাশ দিয়ে এসে আমাদের জনা দশেকের ক্ষুদ্র মুক্তিযোদ্ধা দলের উপর হামলা চালিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। আমরা সীমিত সামর্থ দিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত একটানা ৪ ঘন্টা যুদ্ধ চালিয়ে যাই। আমার সহযোদ্ধা ১৪ বছরের কিশোর এবি সিদ্দিক অন্য যোদ্ধাদের চেয়ে এগিয়ে গিয়ে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে পাক সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে । আচমকা হানাদার বাহিনীর চাইনিজ এলএমজির টানা ব্রাশফায়ার তার শরীরটিকে ঝাঝরা করে দেয়। সেইদিন আরও ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং মশাখালী গ্রামের হাবিবুর রহমান নামে আরও একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। বিকাল ৪টার দিকে পাক হানাদার বাহিনী স্থান ত্যাগ করলে ঐ দিন রাতেই শীলা ব্রীজের অল্প দুরে আওলাজুর গ্রামে একটি কবর খুড়ে সেই কবরেই ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। এরপর আহত মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানকে নিয়ে আমরা পাশ্ববর্তী বলদী গ্রামে আশ্রয় নেই।
গফরগাঁও উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গন কবরের খবর এখন আর কেউ রাখেন না। ১৯৭১ সালের ৫অক্টোবর পাক্বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে উপজেলার মশাখালী ইউনিয়নের শিলা বাজারের কাছে ৫ বীর মুুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একই স্থানে গণকবরে সমাহিত করে সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরেও আওলাজুর গ্রামে ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার গণকবর আজো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। গণকবরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ফলক পর্যন্ত নেই। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার গণকবরের খবর জানেই না। ভালুকা উপজেলার মনুহর পুর গ্রামের কিশোর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর সিদ্দিকের ছোট ভাই আব্দুল খালেক দুঃখ করে বলেন, স্বাধীনতার ৪১ বছরেও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা কোন সাহায্য সহযোগিতা পেলাম না। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গৌতম কুমারের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গণকবরটি পাকা করা হয়। গণকবরে দেয়ালে ৫টি ছোট মিনার দিয়ে ৫জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরন করা হয়েছে। গণকবরের উপরে প্রাপ্ত বয়স্ক ৪জন মুক্তিযোদ্ধার শরীরের মাপে ৪টি ও শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধার শরীরের মাপে একটি কবরের পাকা রুপ দেওয়া হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি এখানে একটি স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মানের। মুক্তিযোদ্ধাদের সে দাবী আজও বাস্তবায়িত হলোনা।