: প্রতি বছর ঘটা করে দেশব্যাপী উদ্যাপিত হয় জতীয় মৎস সপ্তাহ (২-৮ জুলাই)। আয়োজনের মধ্যে থাকে ব্যানার ফেস্টুন সম্বলিত সচেতনতা মূলক বর্ণাঢ্য র্যালী, লিফলেট বিতরন, সভা-সেমিনার, টক-শো, মেলা, উৎসাহিত করনের লক্ষ্যে সফল মৎস চাষীদের মধ্যে পুরষ্কার বিতরন, পোনা মাছ অবমুক্ত করন ইত্যাদি।
২০১৩ সালে জাতীয় মৎস সপ্তাহ উপলক্ষ্যে গোটা দেশের ন্যায় শেরপুরের শ্রীবরদী মৎস দপ্তরের উদ্যোগে নির্বাহী অফিসার গুলশানআরা‘র নেতৃত্বে র্যালী পৌর শহর প্রদক্ষিণ করে। র্যালীতে মৎস কর্মকর্তা কৃষিবিদ দেবযানী ভৌমিক, বিভাগীয় কর্মকর্তা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও মৎস চাষীরা অংশ নেয়। আয়োজনে গনমাধ্যমের ব্যক্তিবর্গ ও গন্যমান্য ব্যক্তিরা আমন্ত্রীত ও সম্মানিত হলেও আমাকে আমন্ত্রন করা হয়নি। গনমাধ্যমে কাজ করি এ কথা প্রশাসনের ও সকলের জানা থাকলেও একটি বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হওয়ার কারনে এমনটি হতে পারে। লেখার লালসা সংবরন করতে না পেরে অভিমান ভুলেগিয়ে মৎস ও প্রানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনায় অতি বিলম্বে হলেও প্রেক্ষাপটটি লেখার সুচিন্তিত প্রস্ততি গ্রহন করি। মৎস বিজ্ঞানীরা সুচিন্তিত ও সময় উপযোগী প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারন করেন এ বছর “মাছে-মাছে ভরবো দেশ, গড়বো সোনার বাংলাদেশ।” দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বর্তমান সরকারের রুপকল্প- ২০২১ বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রেক্ষাপটের উপর মহামান্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট মোঃ আব্দুল হামিদ ও প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিশিষ্ট জনদের জ্ঞান গর্ব বাণী প্রচার হয়। দেশের রপ্তানী আয়ের প্রায় ২.৪৬ শতাংশ আসছে এ খাত হতে। যাহা দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানী খাত হিসেবে চিহ্নিত। বাঙ্গালীর দৈনন্দিন খাদ্যে প্রানীজ আমিষের ৬০ শতাংশ মাছ যোগান দিয়ে আসছে। প্রায় ১৬৫ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মৎস সেক্টরের বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত রেখে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এই বৃহৎ সম্পদের সার্বিক উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রেখে আর্থিক বুনিয়াদ মজবুত সহ স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে মৎস সম্পদ উন্নয়নে অধিকতর সচেতনতা ও সস্পৃক্ত করনের জন্য মৎস অধিদপ্তর , মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়কে শক্তিশালী করছে বলে দাবীদার। ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে সরকারের অর্জিতব্য লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে- *মাছের উৎপাদন ২০০৮ -০৯ সালের (২৭.০১ লক্ষ মেঃ টন ) তুলনায় ২৫% বৃদ্ধিকরন । * জন প্রতি মাছের প্রাপ্যতা ৪৫ গ্রাম থেকে ৫৬ গ্রাম উন্নীত করন। * চিংড়ি ও মৎস জাত পন্য রপ্তানী করে বৈদেশিক আয় এক বিলিয়ন ইউএস ডলার বা আট হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করন । * বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র হ্রাস এবং মৎস চাষে মহিলাদের আংশ গ্রহণ নিশ্চিত করন ।* মৎস চাষি/ মৎসজীবিদের আয় ২০% বৃদ্ধিকরন এবং * দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহন। মৎস অধিদপ্তরের অধিন “ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্ট ” মৎস ক্ষেত্রের বিগত পাঁচ বছরের সাফল্য তুলে ধরেন-
*২০ জনের মৎস চাষী সমিতি গঠন ২৬৭০ টি * মাছচাষ বিষয়ে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চাষী ৫৩ হাজার ৪ শত জন যার মধ্যে মহিলা -৯৬১২ জন * প্রকল্পভূক্ত ও প্রযুক্তি গ্রহণকারী অন্যান্য চাষিদের মোট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি -১ লক্ষ ৬৭ হাজার মেট্রিক টন * প্রকল্পভূক্ত চাষীদের মাছচাষ থেকে গড় আয় বেড়েছে ৩৭% *ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি,মৎস ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক্ল) স্থাপন ৭৩২ টি।
শ্রীবরদী উপজেলা মৎস দপ্তরের বিগত ৫ বছেরের কার্যক্রম- *জাল বিতরন ১১টি * প্রশিক্ষন কেন্দ্র ১০৫টি * বিল নার্সারী স্থাপন ২টি * প্রদর্শনী পুকুর ৪০টি উন্নীত*অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর ১টি * ন্যায্য উৎপাদন ২৫০০ হইতে ৩৩০৫ উন্নীত।
অধুনা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাহসিকতায় আন্তর্জাতিক আদালত (ওঞখঙঝ) এর মাধ্যমে ন্যায্যতা ও অধিকারের ভিত্তিতে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা চুড়ান্ত হওয়ায় ১১১৬৩১ বর্গ কিঃমিঃ/ ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকায় মৎস সহ বিভিন্ন দূর্লভ সম্পদ আহরনে ন্যায় সঙ্গত আধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই সম্পদ সন্ধানে ও আহরনের জন্য সরকার ঢাকা ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে মেরিটাইম এ্যাফেয়ার্স বিষয়। ৪ বছর মেয়াদী কোর্সে অধ্যয়ন করছে শিক্ষার্থীরা। কোর্স সমাপ্ত হলে দক্ষ জনশক্তি বৃিদ্ধ পাবে। সমুদ্র বিজয়ের হীরন্ময় নায়ক সমুদ্র সংকট নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের মনোনিত ডেপুটি এজেন্ট বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সচিব ( মেরিটাইম এ্যাফেয়ার্স ইউনিট ) রিয়ার এডমিরাল (অবঃ ) মোঃ খুরশেদ আলম সাহেবের প্রাথমিক ধারণা মতে সমুদ্রে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। সামুদ্রিক মৎস সম্পদের উন্নয়নের লক্ষ্যে চলমান বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পে মাধ্যমে সামুদ্রিক মৎস সম্পদের স্টক নির্ণয় করে সর্বোচ্চ সহনশীল আহরন মাত্রা নির্ধারণের নিমিত্ত পেলাজিক, ডিমারসেল এং ল্যান্ডবেইজড জরিপ পরিচালনা করার লক্ষ্যে একটি গবেষনা ও জরিপ জাহাজ সহ প্রয়োজনীয় আধুনিক উপককরন ক্রয় প্রক্রিয়া সরকার চুড়ান্ত করেছে। দুঃখ জনক হলেও সত্য এদেশের সকল ক্ষেত্রে মোটামুটি দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন জনবল আছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারনে তারা উপযুক্ত সম্মানী না পাওয়ার কারনে এই মেধা জনশক্তি বিভিন্ন উন্নত দেশে বিনিয়োগ করায় আর্থিক মর্যাদা নিশ্চিত হওয়ার সুবাদে দেশে মেধাশ্রম খাঁটাতে নিরুৎসাহিত হয় অনেকে। ফলে এই দেশটি অপূরনীয় ক্ষতি হতে বসেছে। সমস্যাটি সরকার বিবেচনা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে দেশের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। পূর্ব বাংলার ১৯৫০ সালের অধ্যাদেশ মোতারেক মৎস রক্ষা ও সংরক্ষন আইন প্রতিষ্ঠত হয়। যাহা বাংলাদেশে এখনও প্রযোজ্য। তবে অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বিভিন্ন সময় কিছুটা সংশোধিত হয়েছে। এছাড়া গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আওতাভূক্ত মৎস ও পশু সম্পদ মন্ত্রনালয় ১৯৮৫ সালের ১৬ অক্টোবর এস, আর, ও নং ৪৪২- এল/৮৫ বলে মৎস রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ এর ১৮ নং আইনের ৩ ধারার ক্ষমতা বলে সরকার কর্তৃক প্রনয়নকৃত বিধি দেশে এখনও বিদ্যমান। মৎস সেক্টরের বিধি-বিধান গুলো মাইনর এ্যাক্ট হিসেবে কার্যকর। এখানে মৎসের সংজ্ঞা, আওতা, ক্ষেত্র , কর্মকর্তাদের কর্মক্ষমতা, বিধি-বিধান এবং বিধান লঙ্ঘনকারীদের দন্ডের বিধান সহ সার্বিক তথ্য-উপাত্তের বিন্যাস বর্নিত আছে । আইন যতই প্রনয়ন করা হোক না কেন সচেতনতা , শ্র্রদ্ধাবোধ এবং যথার্থ প্রয়োগ না হলে উহা নিরর্থক হতে বাধ্য। তবে আইনের প্রয়োগ বিভিন্ন সময় গনামাধ্যমে পরিলক্ষিত হয়। ২৪ অক্টোবরে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় “উপকূলে ২১১ জেলে আটক জেল ৯৮ জনের”শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে প্রকাশ মা ইলিশ প্রজনন মৌসুমে ১১ দিনের জন্য জারি করা নিষেধাজ্ঞা কালীন সময়ে ভোলার উপকূলীয় এলাকায় আইন অমান্য করার দায়ে কোষ্টগার্ড ও স্থানীয় প্রশাসন ৩৯০টি অভিযানে ২১১ জন জেলেকে আটক করে। ভ্রাম্যমান আদালত ১ বছর করে কারাদন্ড দেয় ৯৮ জন জেলেদের। ১৩১টি ট্রলার ও ২ কোটি মিটার জাল সহ প্রায় ১৩১ কোটি টাকার মালপত্র জব্দ করা হয়েছে। ফলে মা ইলিশ রক্ষায় এ অভিমানকে সফল দাবী করেন কোষ্টগার্ড ও জেলা মৎস বিভাগ। জাতীয় সংসদ কর্তৃক ২২/০৭/২০১৩ ইং তারিখে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩ অনুমোদন হলে উহা মহামন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করিলে ২০১৩ সনের ২৯ নং আইনে পরিনত হয়। দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত প্রয়োজনে এই কমিশন গঠন বর্তমান সরকারের অন্যতম যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষনা বেক্ষন এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলসহ আর্থ সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে গঠিত কমিশন সফলতা বয়ে আনার দৃঢ় অঙ্গীকার রাখে।
যারা নৌকা বায় এই বৈঠাধারীদের বলে মাঝি। মন মাঝি শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহার হয়। যার ব্যাস বাক্য মানরূপ মাঝি। ইহা রূপক কর্মধারয় সমাস। জাল দ্বারা মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহে নিয়োজিত তাদের বলা হয় জেলে। এই পেশায় নিয়োজিত সংখ্যাগরিষ্ঠদের অঞ্চল সমাজে জেলে পাড়া হিসেবে আখ্যায়িত। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ধর্নাঢ্য ও বিত্তশালীরা মোটা পূঁজি বিনিয়োগ করে প্রকল্প পরিচালনা করে মুনাফা গুনছে তাদের বলা হয় মৎস চাষী। তারা অনেকে আভিজাত বংশের, বিত্তবান ও শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে মৎস চাষী হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত এবং সরকারী আয়োজনে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রেখে পুরষ্কৃত হন। এই ফোটেজ গন মাধ্যমে কলেবরে প্রচার হলে অনেক বিত্তশালী উৎসাহিত হয়ে মৎস পেশার প্রতিযোগীতায় এগিয়ে আসে। জেলেরা মূর্খ, এদের নেই বংশ মর্যাদা,শিক্ষা,বিত্ত ও সামাজিক মর্যাদা। তাই সমাজে এরা নিগৃহিত। জেলে মাঝিদের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য । মানব সভ্যতা থেকে উনিশ শত সত্তরের দশক পর্যন্ত সমাজে এদের কদর ছিল। এখন খুব একটা নেই। নদী মাতৃক দেশের সর্বত্র ছিল খেয়াঘাট। সাগড়, নদী, খাল, বিল, হাওর-বাওরে পারাপার হতে হতো আবল বৃদ্ধ বণিতা। ব্যবহার ছিল নৌকা ও ভেলার। খেয়াঘাটে অপেক্ষমান যাত্রীদের দেখা হতো পুরনো আত্মীয়দের সাথে। হতো কথোপোকথন কুশল বিনিময় পরিচয়ে প্রেম,ভালবাসার বন্ধন হতে চির সাথীও বনে যেত অনেকে। নদীতে পাল তোলা নৌকা বহিত স্বল্প মূল্যে পন্য বহন হতে যাত্রীও যাতায়াত করতো হরহামেশে। সেই সাথে মাঝি গাহিত “মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বইতে পারিনা।” প্রেমিকা গাইত -“যদি বন্ধু যাইবার চাও ঘারের গামছা থুয়ে যাওরে ।” কবি, শিল্পীরাও ভ্রমন করতো নৌকায়। প্রকৃতি,প্রেম,মা-মাটিকে নিয়ে লিখত কবিতা ও গান। এই রচনাতেও জেলে মাঝিদের ঠাঁই হতো। মাঝিরা বেতারে গান শুনার পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে আবহাওয়া বার্তা সংকেত শুনে সতর্ক হয়ে চলে যেত নিরাপদ আশ্রয়ে। জেলে মাঝিদের সুখকর পণ্য ছিল তামাক আর বিড়ি। হরিজন হতে রাজা-বাদশাদেরও বাহন ছিল নৌকা। ১৭৫৭ সালে পলাশির অম্রকানন হতে নবাব সিরাজ উদ-দৌলা পরাজয় বরন করে রণক্ষেত্রে যোগদানের পূনঃ প্রস্তুতির জন্য মূর্শিদাবাদের উদ্যেশে নৌকা যোগে গমন কালে ধৃত হন লর্ভ ক্লাইভের গুপ্তচরের হাতে। আজকাল দিনে নদী, খাল, বিল, হাওর-বাওরে থাকেনা পানি। অসময়ে শুকিয়ে যায়। ফলে বিলুপ্তির পথে অনেক মাছ। কবি গুরু’র কবিতায়-“ আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাঁখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/পার হয়ে যায় গরু,পার হয় গাড়ি।” বৈশাখ তো দূরের কথা অনেক সময় গুরু’র ছোট নদীতে আষাঢ়েও পানি মিলেনা। কবির কবিতাটি ইতিহাসিই রয়ে গেল। কবি মাছের হাঁসির কবিতাও লিখতো, শিশুরা সেই কবিতা ঠোঁঠস্থ করে মজা পেত। বর্ষার আগমনে মাছ ফিরে পেত যৌবন। একটু ঝড় হলেই আগমনি বার্তা বহন করে টাল মাতাল হয়ে পড়তো গ্রাম বাংলার প্রত্যেকটি পরিবারের নাগালের কাছে আসতো মাছ। হরেক রকম হাতিয়ার দ্বারা শিকার করা হতো মাছ। তাই জাতির পরিচয় ছিল মাছে ভাতে বাঙ্গালী । মাছ ছিল জাতির মজ্জাগত অভিলাস। সেকেলে দ্রব্য বিনিময় প্রথা ছিল লক্ষ্যনীয়। সামান্য চালের বিনিময়ে ভোক্তারা পেত পর্যাপ্ত মাছ। ২/১ টাকায় পাওয়া যেত ঢেড় মাছ। জেলেরা বৎসর ব্যাপী মাছ শিকার করে ভোক্তাদের নাগালের কাছে সুলভ মূল্যে বিক্রি করে সানান্য মুনাফা অর্জনেই সন্তুষ্টি লাভ করতো। মৌসুমে চাহিদানুযায়ী মাছ ভোগ করে উদ্ধৃত্ত মাছ শুটকি ও সিঁদল বানিয়ে রাখা হতো আপদ কালীন সময়ের সঞ্চয় হিসেবে। জেলেরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কনকনে শীত উপেক্ষা করে মাছ শিকার করতো। এই জগতে বিস্তির্ণ ভূমি থাকার পরও নদীর পাড়ে আস্তানা গেড়ে ঘেষাঘেষি করে বসবাস করে দু‘বেলা দু‘মুঠো ভাতের প্রত্যাশায়। দরিদ্রতার কষাঘাতে আধুনিক শিক্ষায় সন্তানদের শিক্ষিত করতে না পারায় পূর্ব পুরুষের পেশাটিই বেছে নিতে হতো। সমাজ এদের ঘৃনার চোখে দেখে। সমাজ-দেশ-জাতির উন্নতি হলেও এদের ভাগ্য নিয়ে কাহারও ভাববার সময় নেই। কারণ ওদের গায়ে মাছের দূর্গন্ধ। নির্বাচন আসলে জন নেতারা মিথ্যা বুলি আওরিয়ে ভোট নিয়ে নির্বাচিত হলেও ফিরে তাকাবার সময় নেই তাদের। কালের গর্ভে বিলিন হচ্ছে একটি করে বছর। ফলে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে ম্লান হচ্ছে অনেক কিছু। নদীর খাল বিল ভরাট হচ্ছে। বিচিত্র মাছ বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে ক্রমাগত। অনেক প্রজাতির মাছ আজ চোখে পরে না। মানুষ যখন প্রকৃতির প্রতি নির্মম আচরণ দেখায় তখন প্রকৃতিই নিষ্ঠুর আচরন করে মানব জাতির প্রতি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা সহ বৃহৎ নদী গুলোর ভাঙ্গনে মাইলের পর মাইল ধ্বসে যাচ্ছে প্রতিবছর নদী গর্ভে। জেলে সহ হাজার হাজার মানুষ বাস্তুহারা হয়ে অজানা পথে রিফিউজি বনে গিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে রাজধানীর ফুটপাতে ভীর জমাচ্ছে অহরহ। বর্তমানে নদী ও সাগড় ভিত্তিক আধুনিক যন্ত্রচালিত জেলেরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৎস শিকারের ব্যস্ত থাকলেও অনেক সময় জল দস্যুদের আক্রমনে অপহরন, হত্যা ও গুমের শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি খুলনার একটি হোটেলে পরিবেশ বাদিরা এক সেমিনারে ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষ নদ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। কপোতাক্ষ নদটি মরে গেলে জাতির জন্য বিপর্যয় নেমে আসবে বলে মতামত ব্যক্ত করেন বক্তারা। নদটি আজ সত্যিই মরতে বসেছে। একে বাঁিচয়ে রাখা না গেলে খুলনার, সাতক্ষীরা যশোর সহ এগারটি নদীও মরে যাবে। এর বিরূপ প্রভাব পরবে সেই অঞ্চলের পরিবেশ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর। হুমকির মুখে পরবে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের জীবন-জীবিকা । উদ্বাস্তু হয়ে এলাকা ত্যাগ করতে হবে সিংহ ভাগ জনগোষ্ঠীকে। নদটিকে টিকিয়ে রাখতে টি আর এন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে এলাকার বিল ভূমি উচু করে অঞ্চলটিকে বসবাসের উপযোগী করার নিমিত্তে অবিলম্বে কপোতাক্ষ নদ ড্রেজিং প্রজেক্ট বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগে নেওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন পরিবেশবাদিরা। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যায় চাঁদপুরের মতলবের মেঘনা নদীর তীরবর্তি এলাকার সাড়ে চার হাজার জেলে পরিবারের দূর্দিন অতিবাহিত হচ্ছে। মতলব নদীতে ইলিশ নেই। নৌকা আর জাল চলছেনা। গোটাদিন ঘুরে জেলেরা বাড়ি ফিরে খালি হতে। ডুবোরে দূষন আর ভরা বর্ষায় বৃষ্টি, বজ্রপাত না থাকায় সাগর ছেড়ে মেঘনায় আসছেনা ইলিশ। ফলে মেঘনা উপকূলীয় ষাট নল, জেলেপাড়া, ষটাকী, মোহনপুর, এখলাছপুর ও আমিরাবাদে মেঘনা অঞ্চলের জেলেরা রয়েছে চরম হতাশায়। ইলিশ মৌসুমে জেলে ও আড়তদাররা ব্যস্ত থাকলেও ইলিশের সন্ধান না পাওয়ায় উভয়ে উদ্বিগ্ন। জেলেদের নৌকা, ট্রলার প্রতি লাখ লাখ টাকা দাদন নিয়ে এখন দাদন নেওয়া টাকা পাওয়ার আসায় আড়তে বসে দূঃচিন্তায় ঝিমাচ্ছে ওরা। অপর একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে “বৃহত্তর রংপুরের ৩২টি নদী এখন মরা খাল” শিরোনামের সংবাদে বলা হয়- বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের ৮ জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ছোট বড় ৩২টি নদী পানি ভরাট হয়ে অক্টোবরে প্রথম সপ্তাহেই পানি শুন্য হতে চলেছে। নদীগুলো হারিয়েছে নাব্যতা। ঐতিহ্যের প্রমত্তা, তিস্তা, ধরলা, ব্রক্ষপুত্র, সানিয়াবান, সতিনদী, ভেটেস্বর ও ঘাট সহ বিভিন্ন নদ-নদী এখন মরাখাল, পানি নেই, মাছনেই শুধু ধুধু বালুচর । যৌবনের নদ-নদীর মরদেহে ফসল ফলানো হচ্ছে। আবহমান কাল ধরে নদী গুলোর বুকচিরে বহিত নৌকা ও লঞ্চ। ভারত, পাকিস্তান, ইয়াংগুন সহ অনেক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহজে চাহিদা অনুযায়ী পন্য পরিবহনের নদী গুলোই ছিল একমাত্র ভরসা। ফলে গড়ে ওঠেছিল অনেক নদী বন্দর। কালের আবর্তে নতুন প্রজন্মের কাছে এসব শুধু ইতিহাস হয়েই থাকবে। তিস্তা ও ব্র²পুত্র নদী দুটির থেকে ছোট-বড় প্রায় ৩২ টি নদীর উৎপত্তি। এগুলোতে প্রতি বছর জেগে উঠছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। লাঠিঁ যার চর তার প্রবাদটি এখনও দৃশ্যমান। চর দখল হয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী কর্তৃক। ৭ হাজার কি. মি. নৌ-পথের মধ্যে ৫ হাজার কি.মি. বিপন্ন প্রায়। বহু পূর্বে এখানে গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট কুটিরশিল্প। এসব শিল্প কারখানাও বিপন্নের পথে। জেলেসহ নিয়োজিত শ্রমিকদের ভাগ্য দূর্যোগের ঘনঘটা। পানি শূন্যের কারণে ৩৬ প্রজাতির মাছ হরিয়ে গেছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে এবং সুদুর প্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে নদীগুলোর হারানো যৌবন ফিরিয়ে এনে এ অঞ্চল অর্থনৈতিকক সমৃদ্ধির লাখ লাখ মানুষের আমিষ পূরনের সক্ষম হতে সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সাহিত্য হচ্ছে মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি। জীবনবাদী কথা শিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জেলে-মাঝিদের বাস্তবতা নিপুন শিল্পীর ন্যায় রঙের তুলিতে ছবি একেছেন তার সর্বাধিক জনপ্রিয় “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসে। উপন্যাসের কাহিনীতে বর্ণনা করা হয়- পদ্মা তীরের কেতুপুর গ্রামের দরিদ্র অসহায় জেলে কুবেরের সংসার গড়ে উঠেছে মালা, গোপী, লখা, চন্ডি, বিধবা বোন ও সদ্যজাত পূত্রকে নিয়ে। কুবেরের কর্ম জীবনের সাথী গনেশ, ধননঞ্জয়, রাসু, যুগল, পীতম, কপিলা, অদর, শ্যামদাস, আশ্রয় কর্তা হোসেন মিয়া সহ গ্রামের অনেক মানুষকে নিয়ে কাহিনী বিন্যস্ত হয়েছে। তিরিশের দশকে রচিত লেখকের সার্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাসটি পাঠে মনে হয় হাজার বছর পরও তাজাই থাকবে । তাই লেখক সমৃদ্ধি অর্জন করে বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে পদ্মাতীরের জেলে মাঝিদের বাস্তব জীবন চর্চাকে পরিস্ফুটন করে। কেতুপুরের জেলে মাঝিরা ক্ষুধা, পিপাসায়, কাম-মমতা, স্বার্থ ও সংকীর্নতায় একাকার হয়ে অনাগত জীবনের অনিশ্চয়তা-উদ্বেগকে প্রবলভাবে উপলদ্ধি না করে। জীবনের সীমাহীন কষ্টকেও উপেক্ষা করে না।এদের অভাব- দুঃখ ও বেঁচে থাকার তিক্ততাকে সহজভাবে মেনে নিয়ে টিকে থাকে। সমাজের বিত্তবানরা হরহামেশ ঠকায়। প্রকৃতির নিষ্ঠুর থাবা থেকেও পরিত্রান নেই । ঝড়-বৃষ্টি-রোদে এরা পিষ্ট হয়। শত প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে প্রকৃতির মায়া জালে তবুও বেঁচে থাকার আকুতি স্রষ্ঠার প্রতি। নব জাতক শিশুর ক্ষুধা-ক্রন্দন একাত্ম করে বরন করে নিতে হয়েছে জেলের বাচ্চা জেলেদের। তথাপি ধর্ম, ভগবান কিংবা বিত্তশালীদের তীব্র ক্রোধ নেই। রোগ শোক এদের বিবর্ণ করেনা । এলাকা জুড়ে ভূমির সংকট না থাকলেও কেতপুরে ঘেষাঘেষি করে বেঁচে আছে জেলে মাঝিরা । ওদের যৌন জীবনটিও নৈতিকতা সমর্থন করে না। সদ্যজাত শিশুকেও নিয়েও কুৎসিত মন্তব্য সর্বত্র। নেতি বাচক মন্তব্য থাকলেও কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেন মার্কসবাদী এই লেখক। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় “ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে , ভদ্র পলীতে । এখানে তাহাকে খুজিয়া পাওয়া যাইবেনা।” উপন্যাসের নায়ক কুবের । কুবের ছোট লোকের পোলা এবং দরীদ্রের মধ্যে দরীদ্র। রাতভর মাছ ধরে আর সুযোগমত মাছ চুরিও করে। মহাজন এবং ক্রেতারা ঠকালেও প্রতিবাদ করার সাহস নেই তার। এমনকি ওর পতœীকে নিয়ে কুৎসিত সন্তব্য করলেও নিরব থাকে কুবের। প্রতিবাদের ভাষা নেই ওর। শ্রমজীবি জীবন যোদ্ধা কুবের নিরলস পরিশ্রমী। মাঝে মধ্যে হোসেন মিয়ার পকেটের পয়সাও চুরি করে। শীতল যৌন জীবনে মালার সাথেও অতৃপ্তি হেতু শ্যালিকা কপিলার প্রতি অদম্য যৌন আকর্ষণ। নিষিদ্ধ প্রনয়ে স্বস্তি না পাওয়ায় অন্তর জ্বলেছে দীর্ঘকাল কুবেরের। কপিলার প্রতি প্রেমের চেয়ে আকর্ষন, মুগ্ধতা ও কামলিপ্সা আছে বেশি। কপিলা শুরু থেকে রহস্যময়ী এবং ছলনাময়ী নারীর ভূমিকায় অবতীর্ন। বর্ষার মৌসুমে সারারাত মাছ ধরে কুবের; সাথে ধনঞ্জয় ও গনেশ। ধনঞ্জয় জেলে তবে নৌকা ও জালের মালিক। রাতভর যে মাছ ধরা হয় অর্ধেক ধনঞ্জয়ের অর্ধেক কুবেরের ও গনেশের। নৌকা ও জালের মালিক ধনঞ্জয়ের হওয়ায় পরিশ্রমও করে কম। তাই কুবের ও গনেশ খেটে যাচ্ছে কলুর বলদের ন্যায়। এই ভাবে আশা ভরসা নিয়ে খেটে মরছে কেতুপুরের জেলে মাঝিরা।
মাছে মাছে ভরে উঠুক গোটা দেশ। জেলে মাঝিদের অধিকার নিশ্চিত হয়ে নদী মাতৃক দেশের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসুক এই প্রত্যাশায় প্রেক্ষাপটের ইতি টানি
লেখক : রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব।