হুমায়ুন কবির মৃধা, সিরাজগঞ্জ : দুগ্ধভান্ডার খ্যাত পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের খাঁটি দুধে তৈরি ছানা ও ঘি দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানী হচ্ছে। ঘি ও ছানা বিদেশে রফতানী করে প্রতি বছর প্রায় ৭৫ কোটি টাকার সমপরিমান পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার লাউতারা গ্রামের শশী কান্তি ঘোষ (৩৫) বিএসসি পাস করে বাপ-দাদার বংশক্রম ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। ইচ্ছা ছিল চাকরি অথবা অন্য পেশায় যাওয়ার, কিন্তু জাত ব্যবসা ধরে রাখার জন্য বাবা শ্যামল কান্তি ঘোষের পরামর্শে শশী কান্তি ঘোষকে ছানা ও ঘি তৈরির ব্যবসায়ে মনোযোগী হতে হয়। দাদা অমল কান্তি ঘোষ ছিলেন বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলের নামকরা ছানা ও ঘি উৎপাদনকারী। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় হাতে গোনা যে ৭০-৮০ জন ছানা ও ঘি উৎপাদক রয়েছেন তাদের মধ্যে শশী কান্তি ঘোষ অন্যতম। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন- সরোজিদ কুমার ঘোষ, দুলাল চন্দ্র ঘোষ, বিশ্বনাথ গোষ, পরিমল ঘোষ, পরিতোষ ঘোষ, দুলাল ঘোষ, রবি ঘোষ, মানিক লাল ঘোষ, নবরতœ ঘোষ, মেজর ঘোষ, নব কুমার ঘোষ, রঞ্জিত কুমার ঘোষ, অধির কুমার ঘোষ, রঘু ঘোষ, পরিতোষ ঘোষ প্রমূখ। প্রাণী সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ছোট-বড় প্রায় ১২ হাজার দুগ্ধ খামার রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে গরু পালন করে দুধ উৎপাদন করা হয়। এ অঞ্চলে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এরমধ্যে দেড় লাখ লিটার বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা, এক লাখ ২৫ হাজার লিটার দুধ আফতাব, আকিজ, প্রাণ, ব্রাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়া জাতকারী প্রতিষ্ঠান এবং ঘোষরা ২৮ থেকে ২৯ হাজার লিটার দুধ ক্রয় করে থাকে।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমড়া গ্রামের দুলাল ঘোষ জানান, এ অঞ্চলের ঘোষরা ৮০টি কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ৭০০ মন দুধের ছানা তৈরি করেন। ওই পরিমান দুধে প্রায় ১২৫ মন (পাঁচ টন) ছানা তৈরি হয়। এরমধ্যে ১৮ থেকে ২০ মন ছানা স্থানীয় বাজারে বিক্রির পর বাঁকী ছানা চলে যায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। তিনি বলেন, এক মন দুধ থেকে ৮ কেজি ছানা ও ৩ কেজি ফ্যাট (ননী) তৈরি হয়। তিন কেজি ফ্যাট জ্বালিয়ে দেড় কেজি খাঁটি ঘি পাওয়া যায়। এ হিসেবে দু’টি জেলায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ শ’ লিটার (সাড়ে ২৭ মন) ঘি তৈরি হয়। দেশে বিদেশে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে খাঁটি দুধে তৈরি ছানা ও ঘি’র কদর দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শশী কান্তি ঘোষ জানান, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে প্রতিদিন এক শত মনের বেশি ছানা ও ২৫ মন ঘি ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, ফেনী, কুমিল¬া, নোয়াখালী, খুলনা ও রাজশাহীতে পাঠানো হয়। সিলেট ও চট্রগ্রামে পাঠানো ছানা ও ঘি’র উলে¬খযোগ্য অংশ সেখানকার ব্যবসায়ীরা প্রক্রিয়াজাত করে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন দেশে রফতানী করা হয়। ইংল্যান্ডে আলাউদ্দিন সুইটমিট, জলযোগসহ স্থানীয় কয়েকটি দোকানে এবং আমেরিকায় বনফুল, মধুবনসহ স্থানীয় কয়েকটি মিষ্টির দোকানে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তৈরি ছানা ও ঘি’র খুবই কদর রয়েছে। খাঁটি দুধ থেকে তৈরি ছানা ও ঘি এ অঞ্চলের চাহিদা পুরন করে চলে যাচ্ছে বিদেশে। দুধ, ছানা, মাখন দিয়ে তৈরি হয় ঘি, দই, মিষ্টি, খিরসাসহ বিভিন্ন মিষ্টান্ন দ্রব্য। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় পর্যাপ্ত পরিমান দই, মিষ্টি ও ছানা তৈরি হয়। এ তিনটি দুগ্ধজাত পণ্য বিদেশের মাটিতেও ভোজনবিলাসীদের কাছে সমান সমাদৃত । জানা যায়, এ অঞ্চলে ছানা তৈরির কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় গাভী ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছেনা। ফলে দেশে বিদেশে চাহিদানুয়ায়ী ছানা ও ঘি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল ও নকল ঘি তৈরি করে খাঁটি গাঁওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করছে। এছাড়া নামিদামী কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের লেভেল লাগিয়ে ভেজাল ঘি বাজারজাত করা হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। এর বিরুদ্ধে বিএসটিআই কিম্বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। পাবনা জেলার বেড়া, ডেমরা, পেচাকোলা, হাটুরিয়া, শরিষা, সেলন্দা, সানিলা, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর সিরাজগঞ্জ জেলার লাউতারা, পোতাজিয়া, বাঘাবাড়ী, শাহজাদপুর, সোনাতনী, তালগাছি, উল¬াপাড়াসহ ৩০ টি এলাকায় সব চেয়ে বেশি দুধ সংগ্রহ করে ছানা ও ঘি তৈরি করা হয়। এছাড়া পাবনা ও সিরাজগঞ্জের নামকরা মিষ্টির দোকানগুলো চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমান ছানা তৈরি করে থাকে। জেলা দু’টির মিষ্টির দোকানগুলোতে খাঁটি ছানা থেকে তৈরিকৃত মিষ্টি দ্রব্য বিক্রি হয় মাসে প্রায় ৫ কোটি টাকার। এই মিষ্টি দ্রব্য তৈরির প্রধান উপাদানই হচ্ছে দুধ ও ছানা। ভাঙ্গুড়ার রঞ্জিত ঘোষ জানান, প্রতিদিন খামারিদের কাছ থেকে প্রয়োজন মতো দুধ সংগ্রহ করে তা পর্যাপ্ত পরিমানে জ্বাল দিতে হয়। এরপর জ্বাল দেয়া দুধে রক্ষিত ছানার টক পানি মিশিয়ে আসল ছানা তৈরি করা হয়। একজন ছানা উৎপাদক দুধ, জ্বালানী, লেবার ও পরিবহন খরচসহ ৩০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে প্রতিদিন পাঁচ মন ছানা তৈরি করেন। আর এ তৈরিকৃত ছানা বিক্রি হয় ৩১ হাজার থেকে সাড়ে ৩১ হাজার টাকায়। প্রতিদিন একজন ছানা উৎপাদক এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাভ করে থাকেন। ছানা উৎপাদকদের কাছ থেকে জানা যায়, বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বরফ দিয়ে ছানা তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত টাটকা রাখা যায়। এ প্রক্রিয়ায় পাবনা-সিরাজগঞ্জ থেকে ছানা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। প্রতিদিন এ অঞ্চল থেকে ডে ও নাইট কোচে পাঁচ মন পরিমান এক ঝাকি ছানা এক হাজার টাকায় দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। তারা জানান, সিলেটে ও চট্রগ্রামে পাঠানো ছানা-ঘি স্থানীয় বাজারের চাহিদা পুরন করে ব্যবসায়িরা উদ্বৃত্ত ছানা-ঘি বিশেষ ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াজাত করে ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাঠাচ্ছেন। বিদেশে পাবনা ও সিরাজগঞ্জে তৈরি আসল ছানা ও ঘি’র যথেষ্ট কদর রয়েছে। লাউতারা গ্রামের শশী কান্তি ঘোষ আক্ষেপ করে জানালেন, দীর্ঘ প্রায় ১০ বছরের ব্যবসায়ে বাজারে তার ১৭ লাখ টাকা বাকি পড়েছে। এ রকম অভিযোগ করলেন অন্যান্য ছানা উৎপাদকরা। এ অঞ্চলের ছানা ও ঘি’র কদর রয়েছে দেশের সব জায়গায়। কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়ে বাকি পড়ায় আসল মূলধনে টান পড়েছে অনেক উৎপাদকের। দেশের অন্যান্য জেলা থেকে নিন্মমানের ছানা ও ঘি উৎপাদন করে অল্প মূল্যে তা বাজারে বিক্রি করায় পাবনা-সিরাজগঞ্জে তৈরি আসল ছানা ও ঘি’র বাজারে কিছুটা ধস নেমেছে। ছানা ও ঘি উৎপাদক ঘোষরা জানান, দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখলেও তাদের ব্যাংক থেকে কোন ধরনের ঋন দেয়া হয় না। অন্যদিকে কাঁচামালের ব্যবসায়ে ঝুঁকি থাকায় কোন মহাজন কিংবা কোন এনজিও থেকেও কোন ধরনের ঋন সহায়তা পাওয়া যায় না।
ছানা ও ঘি উৎপাদকরা মনে করেন, সরকার এবং ঋন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ছানা ও ঘি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন তা হলে এ শিল্প থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমান বৈদেশিক মূদ্রা আয়সহ যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।