কুলাউড়া কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল মুক্ত দিবস ৬ ডিসেম্বর
মোঃ খালেদ পারভেজ বখ্শ, মৌলভীবাজার :
মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১সাল, সমগ্র দেশ মুক্ত হয়ে যায়। তবে ৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এই দিনে কুলাউড়া, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল বাসীর স্বরণীয় দিন । সম্পন্নভাবে মৌলভীবাজর জেলার এ তিন থানা (উপজেলা) মুক্ত হয়ে যায়। সারা দেশের মত কুলাউড়ায়, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র-যুবক, শ্রমিক সহ সাহসী ভূমিকা নিয়েছিল। ৭ই মার্চ ১৯৭১সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানের চেহারা পাল্টে যায়। ঐ সময়ে কুলাউড়ার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল থানার স্বদ্বেশ প্রেমিক মুক্তিকামী সন্তানরা হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র।
জুন থেকে কুলাউড়া থানার মুক্তি যোদ্ধাদের সংঘঠিত করতে সে সময় থানার (উপজেলা) ব্যারিষ্টার আব্দুল মুক্তাকিম চৌধুরী, নবাব আলী সবদর খান রাজা, নবাব আলী সরওয়ার খান চুন্ন আব্দুল লতিফ খান, মোঃ আব্দুল জব্বার, মোঃ আব্দুর রহিম, মুকিম উদ্দিন আহমদ, মোঃ আব্দুল মতিন, মোঃ মমরুজ বখ্শ মটু, লুৎফুর রহমান চৌধুরী হেলাল, আলাউদ্দিন আহমদ, আছকির আলী, হাবীব উদ্দিন, আতাউর রহমান, মোছাদুর রহমান,গিয়াস উদ্দিন আহমদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছিলেন। প্রায় ৫৮২ বীর মুক্তিযোদ্ধা হাতে অস্ত্র নিয়েছিল। বাংলাদেশ নামে এই দেশটিকে স্বাধীন করতে। সারা বাংলায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা অত্যাচার নিপীড়ন শুরু হলে কুলাউড়া থানায় তাদের প্রথম আগমন ঘটে ৭ই মে ১৯৭১সাল।
মৌলভীবাজার থেকে কুলাউড়া শহরে ঢুকার পথে কাপুয়া ব্রীজের কাছে গতিরোধ করেন অকুতোভয় বীর সৈনিক মোজাহিদ সদস্য থানার জয়চন্ডী ইউনিয়নের আছকির আলী ও হাবীব উদ্দিন। পাক সেনা ও দু’দলের মধ্যে গুলি বিনিময় চলতে থাকে এক পর্যায়ে তারা দু’জন গুলি বিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এই দুই জনই বীর সন্তান হলেন কুলাউড়া থানা এলাকার স্বাধীনতা বেদীমুলের প্রথম শহীদ। তারপর পাক সেনারা ঢুকে পড়ে চাতলগাঁও গ্রামে ৫জন গ্রাম বাসীকে, শহরের চৌমোহনায় ডেক্সী পাগল নামে একজনকে, শহরে ঢুকে হত্যা করে ছাত্রলীগ থানা শাখার সভাপতি নুরুল ইসলাম ভূইয়া ও তার সহকর্মী এবং আজম বোডিং ম্যানেজার আব্দুর রহমানকে।হত্যা করে। ৫ই এপ্রিল থানার জয়চন্ডী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকার সহযোগে পাক সেনারা ২২জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে হত্যা করে । পরবর্তীতে ২৪শে মে ও ১৪ জুন মীরবক্সপুর গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা সহ একই গ্রামে গিয়ে নিধন যজ্ঞ চালায়।
নভেম্বর শেষ প্রান্তে এবং ডিসেম্বর প্রথম দিকে থানার সবচেয়ে বড় ও সর্বশেষ অপারেশন হয় গাজীপুর চা বাগানে উক্ত চা বাগানে যুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মোগল। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্য বাগানে অবস্থান করছিল। অপরদিকে গাজীপুরের বিপরীতে চোঙ্গা বাড়ী সেখানে মুক্তি বাহিনী ক্যাম্প ছিল। এতে নেতৃত্ব দেন এম এ মোমিত আসুক সাগরনাল চা বাগানে প্রথম এসে অবস্থান নেয় তারা। উক্ত স্থানে মিলিত হন ধর্মনগর থেকে আগত কর্ণেল হর দয়াল সিংহ নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা বাহিনী ৬৭ রাজপুত রেজিমেন্টের বিরাট একটি দল তারাও বাগানে অবস্থান নেয় । সম্মিলিত বাহিনী সবদিকে পাকিস্তানী বাহিনীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ দিকে লষ্করপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উক্ত যুদ্ধে প্রায় ২৫০জন পাক সেনা প্রাণ হারায়। জীবিতরা সবাই পলায়নের চেষ্টা করে।
৫ই ডিসেম্বর গাজীপুর চা বাগান এলাকা মুক্ত হয়। ঐ দিনই সন্ধ্যার দিকে সম্মিলিত বাহিনী কুলাউড়ায় পৌছে, ঐ রাতেই সব পাকিস্তানী সৈন্য ব্রাহ্মণবাজারের দিকে সড়ক পথে কুলাউড়া ত্যাগ করে। এভাবেই ৬ই ডিসেম্বর কুলাউড়া শত্রæ মুক্ত হয়। থানায় লাল সবুজ স্বাধীনতার পতাকা আকাশে উড়তে থাকে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ভারপ্র্রাপ্ত সুশীল চন্দ্র দাস ও সাবেক কমান্ডার আতাউর রহমান তারা দু’জন সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, সেই দিনের পৈশাচিকতা এখনও স্মৃতিতে ভয়াল রুপ নিয়ে ফিরে আসে প্রতি বছর।তারা বলেন, ৭ মে থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকসেনা ও তাদের দোসরা মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র,যুবক ও কৃষক সহ প্রায় ৪৫০জনকে হত্যা করে । তারা আরো বলেন উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংরক্ষণ সহ বধ্য ভূমি সংরক্ষণ ব্যবস্থা আজও করা হয়নি। থানার মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ বিজয় মাসে অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া জরুরী ভাবে সরকার বাস্তবায়ন করবেন বলে অভিজ্ঞ মহল তথা এলাকাবাসী মনে করেছেন ।
অপর দিকে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী সারা দেশের ন্যায় বিভিন্ন স্থানেও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। পাক বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে ধরে এনে এই উপজেলার কিছু কিছু স্থানে নির্বিচারে হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে রাখে।
দেশ স্বাধীনের ৪২ বছরেও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ৬টি বধ্যভূমির মধ্যে ১টিতে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলেও বাকী ৫টি বধ্যভূমির সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি। অরক্ষিত এই ৫টি বধ্যভূমি আজও ঝোঁপঝাড় আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে আছে।
দেশ স্বাধীনের ২৪ বছর পর ১৯৯৫ সনে বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় ও সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল মৌলভীবাজার জেলায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ৮টি বধ্যভূমি বাচাই করেন। তন্মধ্যে কমলগঞ্জ উপজেলায় শুধুমাত্র শমসেরনগর বধ্যভূমিকে চিহ্নিত করা হয় সংস্কার সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। ১৯৯৯ সালে চিহ্নিত এই বধ্যভূমির স্থান সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৭ সালে সেখানে স্মৃতি সৌধ নির্মিত হলেও কমলগঞ্জ উপজেলার দেওড়াছড়া, প্রতাপী, চৈত্রঘাট, ছয়ছিরি ও আদিয়া বধ্যভূমিকে বধ্যভূমি হিসাবে যেমন চিহ্নিত ও বাছাই করা হয়নি, তেমনি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিসৌধ নির্মানের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এসব স্থানে অনেক লোককে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল পাক হানাদাররা।
তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশী গণহত্যা চালিয়েছিল কমলগঞ্জের রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়ায়। এ্কই দিনে সেখানে গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন ৭০ জন চা শ্রমিক। এই স্থানে তাদের স্মৃতিরক্ষার জন্য আজও কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ জাতীয় স্বার্থেই এসব স্থান সংরক্ষন করা অতীব জরুরী।
এছাড়া ৬ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে শ্রীমঙ্গল উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানাযায়,দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ৬ ডিসেম্বর শ্রীমঙ্গল শহরের ভানুগাছ সড়কে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। একইদিনে মৌলভীবাজারের সীমাবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলাও পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর তৎকালীন সংসদ সদস্য আলতাফুর রহমান, কমান্ডার মানিক চৌধুরী ও ফরিদ আহম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে শ্রীমঙ্গলে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। ২৩ মার্চ শ্রীমঙ্গল পৌরসভার সামনে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।
এদিকে, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সেদিন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এ অঞ্চলের নিরীহ চা-শ্রমিকরা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক পর্যায়ে ৩০ এপ্রিল পাকি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে গণহত্যা চালায় তাদের ওপর।
যুদ্ধের বাংকার বানানোর কথা বলে শহর সংলগ্ন ভাড়াউড়া চা বাগানে প্রবেশ করে সেখানে এক সঙ্গে ৫৫ জন চা-শ্রমিককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে তাদের ওপর গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।
সেদিন পায়ে ও পিঠে গুলি খেয়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান চা-শ্রমিক কেদার লাল হাজরা। পরবর্তীতে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে পাকিবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার ৪২ বছর পর সেই গণহত্যার নীরব সাক্ষী হয়ে বেঁচে যাওয়া চা-শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা কেদার লাল হাজরার দিন কাটে অভাব-অনটনে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫টি বধ্যভূমির মধ্যে অন্যতম এই ভাড়াউড়া বধ্যভূমিতে ১৯৯৭ সালে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হলেও পূর্ণাঙ্গতা পায়নি আজও। এছাড়া সাধুবাবার বটতলী হিসেবে পরিচিত বধ্যভূমিটি স¤প্রতি সংস্কার করে ‘বধ্যভূমি ৭১’ নামে গড়ে তোলা হলেও অন্যগুলো পড়ে আছে অযত্মে আর অবহেলায়। এসব বধ্যভূমিতে সীমানা প্রাচীর পর্যন্ত নেই