ইমরান হোসাইন, তানোর : এই উপজেলার গুচ্ছগ্রামের নাম পাল্টিয়ে করা হয়েছে আদর্শ গ্রাম। গ্রামের নাম পরিবর্তন করা হলেও এখানকার মানুষের জীবনমানের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বহুবিদ সমস্যায় নিমর্জ্জিত থেকে দিনরাত পার করতে হচ্ছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার এসব আদর্শ গ্রামের বাসিন্দাদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বাধাইড় ইউপির রামদেবপুর, ভান্ডাল ও পাঁচন্দর ইউপি’র কয়েলহাট আর তানোর পৌরসভার মাসিন্দা এলাকায় ৪টি আশ্রয়ন নিরাপদ আবাসন (গুচ্ছগ্রাম) স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে এসব আবাসনগুলোর নাম রাখা হয় আদর্শ গ্রাম। নিরাপদ দরিদ্র, অতিদরিদ্র ও ভূমিহীন মানুষের আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের জন্য এ আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোর (গুচ্ছগ্রাম) সৃষ্টি হলেও পর্যাপ্ত সহযোগীতা, কর্ম সৃষ্টির অভাব, কর্তৃপক্ষের অবহেলায় প্রকল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্য এখন ব্যাহত হতে চলেছে। এসব আদর্শ গ্রামে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও স্যানিটেশনসহ নানান সমস্যায় চরম দুর্ভোগ পোয়াচ্ছেন এখানকার বাসিন্দারা। ফলে, মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে তানোরের বাধাইড় ইউপি’র রামদেবপুর এলাকায় প্রায় ২০ বিঘা সরকারি খাস জমিতে এবং ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে একই ইউপি’র ভান্ডাল এলাকায় প্রায় ১৫ বিঘা সরকারি খাস জমিতে পৃথক আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও ১৯৯০-১৯৯১ অর্থ বছরে তানোর পৌর এলাকার মাসিন্দা এলাকায় ১১টি আর ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে পাঁচন্দর ইউপি’র কয়েলহাট এলাকায় ৩০টি পরিবারের জন্য সরকারি জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি করা হয়। ওইসব নির্মাণকৃত প্রকল্প এলাকার লোকজনের আশ্রয় ও জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করার জন্য প্রতিটি পরিবারকে ৪ থেকে ৫ শতাংশ করে জমি দলিল করে দেয়া হয়। প্রকল্প এলাকায় রামদেবপুরে ৩টি পুকুর ও ভান্ডালে ২টি পুকুর খনন করা হয়। রামদেবপুরে ১০টি ব্যারাকে ৮০টি ও ভান্ডালে ৫টি ব্যারাকে ৫০টি অসহায় পরিবারকে একটি করে ঘর, একটি ব্যারাকে একটি করে টিউবওয়েল ও একটি করে টয়লেট দেয়া হয়। এছাড়া আশ্রয়ণে বসবাসরত লোকজনের বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনার জন্য গঠন করা হয় সমবায় সমিতি ও কমিউনিটি রুম। একই ভাবে মাসিন্দা ও কয়েলহাট গুচ্ছগ্রামগুলোতে এক একটি সমপরিমান পরিবারের চাহিদা পূরণে টিউবওয়েল ও টয়লেট দেয়া হয়েছে। এসব দিয়ে গুচ্ছগ্রামের নামকে পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে আদর্শ গ্রাম। কিন্তু এসব গ্রাম গুলোতে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় এখানে আদর্শের এটুকু ছোয়া লাগেনি।
এসব নিয়ে প্রকল্প এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা অভিযোগ করে বলেন, বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারিয়ে দিনের পর দিন স্থানীয় মেম্বার/চেয়ারম্যানদের কাছে ধর্না দিয়েও পাওয়া যায় না বয়স্কভাতা বা বিধবাভাতার কার্ড। ফলে, কর্মক্ষমতা হারানো বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা কোন উপায় না পেয়ে বেছে নেয় ভিক্ষার পথ। শুরুতে সেখানে কোন ভিক্ষুক না থাকলেও এখন সেখানে ভিক্ষুকের সংখ্যা সাত থেকে আটজন। টিউবয়েলগুলো একের পর এক বিকল। আর ল্যাট্রিনগুলো হয়ে পড়েছে ব্যবহার অনুপযোগী। ফলে, তাদের জীবন-যাপন নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য এখন হুমকির মুখে।
সরেজমিনে গত শনিবার আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, রামদ্পেুরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৮০টি পরিবারের মধ্যে আদিবাসী ২৭টি ও মুসলমান প্রায় ২০টি পরিবার বসবাস করলেও, অভাবের তাড়নায় বাকিরা সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে। ফলে, তাদের নামে বরাদ্দকৃত ঘরগুলো এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় নষ্ট হয়ে গেছে। আশ্রয়ণের ৩টি পুকুরের মধ্যে ২টি পুকুর বহিরাগতদের মাঝে লীজ দেয়া হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাবার একটি মাত্র পথ তবুও কাঁচা কাদা মাটির রাস্তা। একটু বৃষ্টি হলেই তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সবেমাত্র বিদ্যুৎ দেয়া হলেও বিলের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় অনেক সংযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। এখানে নেই কোন স্কুল, মসজিদ ও মন্দির। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় পিছিয়ে এখানকার শিশু ও অধিবাসিরা।
এব্যাপারে রামদ্পেুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিবাসি মনজু আলী জানান, ল্যাট্রিনগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী ও পাঁচটি টিউবওয়েলের মধ্যে চারটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তবে, আশ্রয়ণের অধিবাসীদের মধ্যে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্য যে বৈদ্যুতিক মটর স্থাপন করা হয়েছিল সেটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ তাঁর নিজের চাতালে নিয়ে স্থাপন করেছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিবাসী নরেশ কিস্কু(৫০) অভিযোগ করে বলেন, তিনি ৩ ছেলে মেয়ে নিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সেখানে কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। ফলে, পাশের কোন গ্রামে গিয়ে তাকে কাজের সন্ধান করতে হয়। যেদিন কোন কাজ পায় সেদিন পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার ওঠে। আর যেদিন কোন কাজ পায় না সেদিন তাঁদের না খেয়ে উপোস থাকতে হয়। এনিয়ে আব্দুল হালিম (৩৫) বলেন, এখানে কর্মসংস্থানের অভাবে চরম দারিদ্রতার কবলে পড়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে অধিকাংশ পরিবার আশ্রয়ণ স্থল ত্যাগ করেছে। ফলে তাঁদের নামে বরাদ্দকৃত ঘরগুলো এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। তিনি আরোও অভিযোগ করে বলেন, আগেই তারা ভালো ছিলেন বিপদে প্রতিবেশিদের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগীতা পেতেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাস করায় তারা সরকারি কোন সাহায্য-সহযোগীতা পান না আবার আশপাশে কোন বসতি না থাকায় প্রতিবেশিদেরও কোন সাহায্য-সহযোগীতা পাওয়া যায় না। বিজয় টুডু (৫৫) আক্ষেপ করে বলেন, এখানে তাদেরকে ঘর দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। তারা কেমন আছেন তা খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। তারা আশ্রয়ণবাসী কোন সাহায্য-সহযোগীতা পায় না। আদিবাসী হওয়ায় কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকাই তারা বাধ্য হয়ে সেখানে পড়ে রয়েছেন। এক্ষেত্রে ভান্ডাল আর কয়েলহাটসহ মাসিন্দা আশ্রয়ণ (গুচ্ছ) গ্রামগুলোর আশ্রয় স্থলের বাসিন্দারা একই সমস্যায় চরম দূর্ভোগ পোচ্ছেন।
এব্যাপারে তানোর আবাসন (গুচ্ছগ্রাম) প্রকল্পের সদস্য সচিব তানোর সহকারি কমিশনার (ভূমি) (এসিল্যান্ড) উজ্জল কুমার ঘোষ বলেছেন, ওইসব আবাসন আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলো সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা স্থাপন করে চলে গেছেন। বর্তমানে ওইসব গুচ্ছগ্রামগুলোর কোন বাজেট বরাদ্দ না থাকায় আশ্রয়ণের অধিবাসিদের সহযোগিতা করা সম্ভব হয় না বলে জানান তিনি।