ঠাকুরগাও প্রতিনিধি : আজ ৩ ডিসেম্বর। ঠাকুরগাও মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটলে সমগ্র জেলা শত্র“মুক্ত হয়। তাই এই দিনটিকে মুক্ত দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ জেলায় অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধ করে পাক হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্থ করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ জেলাকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষনা করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক প্রতিরোধের পরেও ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা সারাদেশের ন্যায় ঠাকুরগাও জেলাকে তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। তাদের অমানুষিক অত্যাচার নির্যাতনে স্থানীয় লোকজন বাড়ীঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আত্বগোপন করে। কেউ কেউ ভিটে-মাটি, ধন-সম্পদ ফেলে জীবন বাচাতে ভারতের শরনার্থী ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাংলার দামাল ছেলেরা পাক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে টিকতে পারছিলনা। তাই তারা সাময়িকভাবে পিছিয়ে গিয়ে নতুন করে আক্রমনের পরিকল্পনা করতে থাকে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর উপর একের পর এক গেরিলা হামলা চালাতে থাকে। অব্যাহত হামলায় পর্যুদস্ত হতে থাকে পাক বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকা মুক্ত হতে থাকে। ক্রমাতভাবে পিছু হটতে থাকে পাক বাহিনী। জেলার হরিপুর থানা এলাকা প্রথম শত্র“মুক্ত হয়। এর পরে রানীশংকৈল, পীরগঞ্জ, বালিয়াডাঙ্গী ও সদর থানা মুক্ত হয়।
সম্মুখ যুদ্ধে জেলার মুক্তিকামী মানুষদের মধ্যে ১ম শহীদ হন পীরগঞ্জের বীর যোদ্ধা ্আবু ইসাহাক। এই শহীদের নামে শহরের একটি সড়কের নামকরন করা হয়েছে। পীরগঞ্জে টগবগে যুবক সালাহ উদ্দিনকে ক্ষুধার্ত বাঘের খাচায় নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। কলেজ শিক্ষক শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা ও তৎকালীন থানা আওয়ামীলীগ সভাপতি ডা. সুজাউদ্দিনসহ কয়েক জনকে প্রকাশ্যে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয়।
কিন্তু যাঁদের রক্তের বিনিময়ে জাতি পেল স্বাধীন ভূখণ্ড, পনের কোটি মানুষ পেয়েছে লাল-সবুজ পতাকা, স্বাধীনতার প্রাপ্তি কী জুটেছে তাদের কপালে ? স্বাধীনতার ৪১ বছর পর আজও বিচার হয়নি জাঠিভাঙ্গাসহ হাজার হাজার বাঙালির ঘাতক যুদ্ধপরাধীদের, তাদের বিধবা পতœীরা আজও আছেন অধীর প্রতিক্ষায়। আজও বিচার পাননি রুহিয়ায় পরিবারের ৬ সদস্যকে হারানো নাজিমউদ্দীন। কোনো বিচারই হয়নি এখনো, যাদের স্বজনদের রক্ত সেদিন রঞ্জিত করেছিল রাণীশংকৈলের খুনিয়া দীঘির জল। এসব নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই জীবিত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শহীদ পরিবারবর্গের।
তখন ঠাকুরগাঁও ছিল উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা। বর্তমান ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার ১০টি থানা ছিল এই মহকুমার অন্তর্গত। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওবাসী গড়ে তুলেছিলো দুর্বার প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধের কারণেই ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি ঠাকুরগাঁওয়ের মাটিতে।
১৫ই এপ্রিল ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে মুহুর্মুহু শেল বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকে পড়ে হানাদার বাহিনী। তবে তেতুলিয়া থানাকে কেন্দ্র করে ১৫০ বর্গমাইলের ১টি মুক্তাঞ্চলকে কেন্দ্র করে গঠিত ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২ ডিসেম্বর প্রচন্ড গোলাগুলির পর শত্র“ বাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে ২৫ মাইল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঠাকুরগাঁও শহর হয় শত্র“মুক্ত।
তারপর পেরিয়ে গেছে ৪১ বছর কিন্তু শত্রুমুক্ত হওয়ার এতও বছর পেরোলেও আজও শাস্তি পায়নি যুদ্ধাপরাধীরা যারা জাঠিভাঙ্গাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে নির্বিচারে। বরং শহীদ পরিবারগুলোই আজ অবহেলিত মানবেতর জীবন যাপন করছে। তারই চিহ্ন বহন করছে ঠাকুরগাও সদর উপজেলার শূখান পুকুর ইউনিয়নের বিধবা পল্লী¬র পরিবারগুলো। শহীদ ও মুিক্তযোদ্ধা পরিবারকে রক্ষায় এবং এ অঞ্চলের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হোক এ দাবি ঠাকুরগাঁওবাসির।
