এম. এ করিম মিষ্টার, নীলফামারী : নীলফামারী জেলার ৪ টি আসনেই দশম জাতীয় সংসদকে ঘিরে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের চলছে গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ। সর্বত্রই ছেয়ে গেছে পোস্টার, ফেস্টুন আর ব্যানারে। অংশ নিচ্ছেন সভা-সমাবেশ ও আলোচনা সভায়। প্রধান দুই দলেই রয়েছে গ্রুপিং ও কোন্দল। তবে জেলার শীর্ষ নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগেই এগুলো মিটিয়ে ফেলা হবে। মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরে জেলার মানুষের কিছু চাওয়া-পাওয়া পূরণ হলেও এখনও পূরণ হয়নি অনেক গণদাবি। তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ সরকারের নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে দূর হয়েছে এ অঞ্চলের মঙ্গা নামক অভিশাপ।
নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা) : এ আসনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির প্রার্থী জাফর ইকবাল সিদ্দিকী নির্বাচিত হন। তিনি সরকারী ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এলাকার সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখায় তার অবস্থান পূর্বের চেয়েও মজবুত। যদি এরশাদের জাপা মহাজোট থেকে বেরিয়ে গেলে তিনিই হবেন জাতীয় পার্টির একমাত্র প্রার্থী। অপরদিকে মহাজোট ভেঙ্গে গেলে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে পারেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ড. হামিদা বানু শোভা। এছাড়াও মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রেখেছেন আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট মনোয়ার হোসেন, ডিমলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফতাব উদ্দিন সরকার, সাবেক রাষ্ট্রদূত আমিনুল হোসেন সরকার, কৃষিবিদ ড. আবু ইনামদার, নীলফামারী জেলা পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মমতাজুল হক।
এ আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভগ্নিপতি ও নীলফামারী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার শাহরিন ইসলাম তুহিনের বাবা প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। তবে ইঞ্জিনিয়ার শাহরিন ইসলাম তুহিনের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা থাকায় দেশের বাইরে থাকায় এলাকায় তার অবস্থান নড়েবড়ে। তবে তিনি খুব শীঘ্রই এলাকায় ফিরে আসবেন বলে তাঁর পারিবারিক সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে তিনি বাবার পরিবর্তে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন। অপরদিকে এই আসনে ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থিতার জন্য তৎপর রয়েছেন জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (ন্যাপ) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী শফিকুল গনি স্বপনের ছেলে ব্যারিস্টার জেবেল রহমান গনি। ইছহাক আলীর জামায়াতের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসাবে মাঠে রয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের মোটামুটি চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবেই মাওলানা মঈনুল ইসলামের নাম শোনা যাচ্ছে।
নীলফামারী-২ (সদর) : বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রচার ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক বিশিষ্ট অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এ আসনে পরপর দুবার নির্বাচিত হয়েছেন। সরকারী ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করায় তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এ আসনে মহাজোটের একমাত্র প্রার্থীর দাবিদার তিনি। সে হিসেবেই দলীয় ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা প্রতিমাসে এলাকা সফর করে চলছেন নিয়মিত। এদিকে এ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নীলফামারী পৌরসভার পর পর ৫ বারের নির্বাচিত মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ প্রার্থী হতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। অপরদিকে মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় পার্টি (এরশাদ) যদি মহাজোট থেকে বের হয়ে গেলে এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন মনোনয়ন পেতে পারেন।
এ আসনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট প্রার্থী নিয়ে রয়েছে মহাবিপাকে। এখানে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন শামসুজ্জামান জামান, আহসান হাবীব লেনিন, আমেরিকা প্রবাসী ও সাবেক ছাত্রদল নেতা কাবেরুল ইসলাম লিটন ও জামায়াতের নায়েবে আমির মনিরুজ্জামান মন্টু, জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক আবু হেলাল। এ আসনটিতে জামায়াত-বিএনপি কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এ নিয়ে মহাবিপাকে ১৮ দলীয় জোট। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থী ছিলেন জেলা জামায়াতের বর্তমান নায়েবে আমির মনিরুজ্জামান মন্টু। তিনি মহাজোটের প্রার্থী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে লড়াই করে স্বল্প ব্যবধানে পরাজিত হন। তাই তিনি আসনটি উদ্ধারের জন্য মরিয়া। তবে এবার এই আসনে জামায়াতকে ছাড় দিতে নারাজ নীলফামারী বিএনপি। বিগত নির্বাচনগুলোতে এই আসনে বিএনপির শক্ত প্রার্থী না থাকায় প্রার্থিতা চাইতে পারেনি তাঁরা। কিন্তু এবার জামায়াতের থেকেও শক্তিশালী প্রার্থী খুঁজে পেয়েছে বিএনপি। এবার এ আসনে ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও শিল্পপতি আলহাজ্ব শামসুজ্জামান জামান, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও নীলসাগর এ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাবীব লেনিন। এছাড়াও নীলফামারী কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে কাবেরুলের বিএনপির প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামী আন্দোলন এই আসনে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নাম একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে।
নীলফামারী-৩ (জলঢাকা-কিশোরীগঞ্জ) : এই আসনে বর্তমান এমপি মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় পার্টির কাজী ফারুক কাদের। দেশ স্বাধীনের পর থেকে মরহুম আজাহার আলী টানা আসনটি ধরে রাখলেও তাঁর অবর্তমানে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে আসনটি চলে যায় জামায়াতের ঘরে। ফলে আসনটি উদ্ধারে ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্লিন ইমেজের স্কুলশিক্ষক দীপেন্দ্রনাথ সরকারকে প্রার্থী করা হলেও নেতৃত্বের কোন্দলে পরাজিত হন তিনি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির কাজী ফারুক কাদেরকে মনোনয়ন দেয়া হয়। তিনি জামায়াতের প্রার্থী মিজানুর রহমানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন। এবার আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করলে মনোনয়ন লবিংয়ে এগিয়ে থাকবেন গোলাম মোস্তফা। এছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনছার আলী মিন্টু, সাধারণ সম্পাদক শহীদ হোসেন রুবেল, আওয়ামী লীগের সদস্য বাবু দীপেন্দ্রনাথ সরকার।
এ আসনে বিএনপির কান্ডারি ছিলেন সাবেক পৌর মেয়র মরহুম আনোয়ারুল কবির চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুর পর বিএনপি ভুগছে নেতৃত্ব শূন্যতায়। তাঁর ছেলে ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী কমেড স্থান দখলের চেষ্টা করলেও দলের অনেক সিনিয়র নেতা মেনে নিতে পারছে না তাঁকে।তবে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী কমেড। এছাড়াও এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে রংপুর বিএনপির অন্যতম নেতা শামসুজ্জামান সামু ও নীলফামারী জেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য সনেট চৌধুরী মনোনয়ন পেতে তৃণমূলে গণসংযোগ, কেন্দ্রে জোর লবিং চালিয়ে আসছেন। অন্যদিকে ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত থেকে উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আজিজুল ইসলাম ও শিল্পপতি আলহাজ সৈয়দ আলী সৈয়দ আলী মনোনয়নের জন্য জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর-কিশোরীগঞ্জ) : এ আসনটি সৈয়দপুর উপজেলা ও কিশোরীগঞ্জের আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত। অবাঙালী অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরের বিহারী ভোটারদের ওপরই জয়-পরাজয় অনেকটা নির্ভর করে। এ আসনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রার্থী কর্নেল (অব:) এএ মারুফ সাকলানের প্রার্থীতা পরিবর্তনের কোন পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি। দলের কতিপয় নেতাকর্মী নানা দূর্নীতি-অনিয়মের সাথে জড়িত থাকায় দলের একাংশ এমপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নানা কার্যকলাপে স্থানীয় নেতারা তাঁর ওপর নাখোশ। তবে অন্যান্যবারের মত আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার সেকেন্দার আলী, সাবেক পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আখতার হোসেন বাদল, ব্যারিস্টার মোখছেদুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য আমেনা কোহিনূর আলম মনোনয়ন দৌড়ে তৎপর রয়েছেন। এ আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও বর্তমানে সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ আমজাদ হোসেন সরকার প্রার্থী হবেন এটা প্রায় নিশ্চিত। তিনি সৈয়দপুর-কিশোরীগঞ্জ এলাকার উন্নয়নে বিশেষ করে সৈয়দপুরকে শিক্ষা নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তার বিভিন্ন কর্মকান্ড, ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়নের কারণে দলের একটি অংশ তাঁর কাছ থেকে অনেকটাই দূরে রয়েছেন। এছাড়া দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন অধ্যক্ষ আব্দুল গফুর সরকার। ব্ল্যাক ডায়মন্ডখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী বেবী নাজনীন বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ শওকত চৌধুরী এ আসনে নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন এরশাদ।