এমএ ছালাম, নওগাঁ : উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জেলা নওগাঁর ৬টি সংসদীয় আসনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা-গণসংযোগ বেশ জমে উঠেছে। নানা কৌশলে তারা নিজের নির্বাচনী এলাকায় প্রচার-প্রচারণাসহ দলীয় নেতা-কর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের খোজ-খবর নিচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা অন্যের চেয়ে নিজেকে ভাল হিসেবে প্রতিষ্ঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সাধারণ মানুষের কাছে। চালাচ্ছেন দলের পক্ষে ও নিজের পক্ষে প্রচারণা। প্রতিটি আসনেই আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। দলীয় মনোনয়ন পেতে সকল প্রার্থীরাই দলীয় হাই কমান্ডে দৌড়-ঝাঁপ করছেন। লবিং ও তদবিরেও তারা পিছিয়ে নেই। ওই অবস্থায় বসে নেই জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় সমর্থন কে পাবেন এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। তবে এবারও অনেক নতুন মুখ দলীয় মনোনয়নের জন্য বিরামহীন ছুটোছুটি করছেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ জেলার ৬টি আসনেই মহাজোট সমর্থিত আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। দশম সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা তাদের নিজ নিজ আসন ধরে রাখতে চান। অপরদিকে এসব আসন বিএনপিও দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেই লক্ষ্যে আওয়ামীলীগ সমর্থিত সম্ভাব্য প্রার্থীরা বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরে সাধারণ মানুষদের মন গলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি মসনদ ফিরে পেতে সরকারের ব্যর্থতা, দলীয় নেতাকর্মীদের টেন্ডারবাজি-দখলবাজির কথা তুলে ধরে মানুষের আস্থায় ফিরতে চাচ্ছেন।
নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর-পোরশা-সাপাহার) : আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য সাধন চন্দ্র মজুমদার এবারও এ আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তির বিষয়ে প্রচন্ড আশাবাদী। তার মেয়াদে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়িত হয়েছে। সেই দাবিকে সামনে রেখে তিনি এবারও দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। এলাকার উন্নয়নে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। দলীয় মনোনয়ন পেলে আবারও তিনি এমপি নির্বাচিত হবেন বলে আশাবাদী। অন্যদিকে নবম সংসদ নির্বাচনে নিকটতম প্রার্থী বিএনপির সাবেক এমপি ডা. ছালেক চৌধুরী এবারও দলীয় মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইতোমধ্যেই তিনি গণসংযোগের পাশাপাশি দলীয় লবিং অব্যাহত রেখেছেন্। দলীয় মনোনয়ন পেলে তিনি জয়লাভ করবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এ আসনে সাপাহার উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুন নূর, পোরশা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহা. মাসুদ রানা দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। ইতোমধ্যেই তারা গণসংযোগের পাশাপাশি দলীয় হাইকমান্ডে লবিং শুরু করেছেন। অপরদিকে জাতীয় পার্টির একমাত্র প্রার্থী মো. আকবর আলী (কালু) গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। জামায়াতের অধ্যাপক ছালেকুর রহমানও প্রার্থী হচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
নওগাঁ-২ (পতœীতলা-ধামইরহাট) : এ আসনে বড় দল আওয়ামীলীগ-বিএনপির একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী ইতোমধ্যেই পৃথক পৃথকভাবে গণসংযোগ শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি আলহাজ্ব শহীদুজ্জামান সরকার বাবলু এবারেও মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি এলাকার বেশ উন্নয়ন করেছেন। তবে ধামইরহাট সীমান্তের প্রস্তাবিত চৌঘাট কড়িডোর এ সরকারের আমলে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে কিছুটা হলেও অসন্তোষ রয়েছে। এছাড়া দলীয় কিছু কর্মীর সরকারী জমি দখলসহ নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকান্ডে স্থানীয়দের মনে বিরূপ প্রভাব বিরাজ করছে। তবে বাবলু সরকার তার দক্ষতা দিয়ে সেসব সামলে নেয়ার চেষ্টা করছেন। এ আসনে নবম নির্বাচনের আগে থেকে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করে চলেছেন ইঞ্জিনিয়ার আখতারুল আলম। ঈদসহ নানান প্রয়োজনে এলাকার নানান শ্রেণী-পেশার মানুষের মাঝে বিভিন্ন উপকরণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য তিনি এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগের পাশাপাশি তিনি কেন্দ্রেও লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোনয়ন পেলে তিনিও জয়লাভের ব্যাপারে আশাবাদী। এ আসনে আওয়ামীলীগের জেলা বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক নজিপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আলহাজ্ব আমিনুল হকও এবার মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। মনোনয়ন পেলে তিনি এলাকার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করবেন। জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি শামছুজ্জোহা খান ও জেলা কৃষক দলের সহসভাপতি দাবীদার খাজা নাজিবুল্লাও মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন। শামছুজ্জোহা খান এমপি থাকাকালীন এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। এবার তিনি নতুনভাবে জয়লাভের আশায় দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ভোট করবেন এবং জয়লাভও করবেন বলে জানান। অপর প্রার্থী খাজা নাজিবুল্লা নবম নির্বাচনের সময় থেকে মনোনয়ন লাভের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এবার দলীয় মনোনয়ন পেলে তিনি জয়লাভ করবেন বলে আশাবাদী। এ আসনে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন দলীয় একক প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) : এ আসনে বর্তমান এমপি আলহাজ্ব ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল এখনও চরম অবস্থায় থাকায় ওষ্ঠাগত হতে পারেন তিনি, ওই আশঙ্কায় এ আসনে মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা চেরাগপুর ইউপি চেয়ারম্যান ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় এখন ব্যাপক তৎপর। এছাড়া এ আসনে দলীয় মানোনয়ন পেতে মাঠে নেমেছেন সাবেক আমলা বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল কবির। অন্যদিকে এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পীকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী, জেলা বিএনপির সদস্য ফজলে হুদা বাবুল ও মহাদেবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াছাত হায়দার টগর। তারা পৃথক পৃথকভাবে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। সেই সঙ্গে কেন্দ্রেও লবিং করছেন মনোনয়ন লাভের আশায়। এখানে জাতীয় পার্টির দুই জন প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। একজন হলেন সাবেক এমপি বিএসএ হুমায়ুন কবীর চৌধুরী ও আব্দুন নাসের পারভেজ চৌধুরী। গণসংযোগের পাশাপাশি মনোনয়ন লাভে তারা লবিংও করছেন।
নওগাঁ-৪ (মান্দা) : এ আসনে এবার বড় দুই দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপির একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর নাম শোনা যাচ্ছে। নবম সংসদ নির্বাচনে ওই আসনে স্বতস্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে এমাজ উদ্দিন প্রামাণিক এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে স্বীকৃত হন। এমাজ উদ্দিন প্রামাণিকের পাশাপাশি আব্দুল লতিফ শেখও এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে আরও যারা মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে তারা হলেন মান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরদার জসিম উদ্দিন, এ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান, সাইদুর রহমান বকুল ও ডাঃ আব্দুর রহমান। এ উপজেলায় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের মাঝে অভ্যন্তরিণ কোন্দল রয়েছে। এমপির নাম ভেঙ্গে সরকারী হাটের জায়গাসহ জমি দখল, পুকুর দখল, সংখ্যালঘুর জমি দখলসহ নানা বিতর্ক রয়েছে দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ আসনে একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক এমপি বিএনপির সামসুল আলম প্রামাণিক এবারেও দলীয় মনোয়ন নিয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন। তিনি রীতিমত গণসংযোগ শুরু করেছেন। তিনি ছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্যান্যরা হলেন মান্দা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান ডা. ইকরামুল বারী টিপু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক আব্দুল মতিন, উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ইসাহাক আলী সেন্টু ও ইঞ্জিনিয়ার আক্কাস আলী। এ আসনে জাতীয় পার্টির এ্যাডভোকেট এনামুল হক ও এ্যাডভোকেট আলতাফ হোসেন মনোনয়ন প্রত্যাশায় তৎপর বলে জানা গেছে।
নওগাঁ-৫ (সদর) : এ আসনে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল এমপির মৃত্যুর পর মূলত: দলীয় অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ে গোটা নওগাঁ জেলা। তার মৃত্যুর পর নওগাঁ সদর আসনে উপ-নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু অভ্যন্তরিণ কোন্দল এখানে চরম অবস্থায়। নওগাঁ সদর আসনে নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব সব সময়ই পড়ে এসেছে জেলার অন্য ৫টি আসনে। ফলে এ আসনে প্রার্থী সিলেকশন সকল দলের হাই কমান্ডকে ভেবে চিন্তে করতে হয়। আর সে কারণেই উভয় দলের হাইকমান্ড এ আসনে সতর্কতা অবলম্বন করেন। এবার এ আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন বর্তমান এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আব্দুল মালেক, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত আব্দুল জলিল এমপির স্নেহধন্য মোঃ ইসহাক আলী, সংরক্ষিত আসনের এমপি বেগম শাহিন মনোয়ারা হক, এফবিসিসিআই এর সাবেক পরিচালক আলহাজ্ব শামসুল হক, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের সিদ্দিক এবং সাবেক যুবলীগ সভাপতি আলহাজ্ব রফিকুল ইসলাম রফিক। এদের মধ্যে আব্দুল মালেক এমপি, শাহিন মনোয়ারা হক এমপি এবং ইস্হাক আলী রীতিমত গণসংযোগ শুরু করেছেন। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন কর্ণেল আব্দুল লতিফ খান, লায়ন নাজমুল হক, নওগাঁ পৌর মেয়র নাজমুল হক সনি, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ধলু ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জালাল আহমেদ বকুল। ইতোমধ্যে তারা গণসংযোগের পাশাপাশি মনোনয়ন প্রত্যাশায় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নওগাঁ-৬ (রাণীনগর-আত্রাই) : এ আসনে আওয়ামীলীগের বর্তমান এমপি ইসরাফিল আলম আবারও দলীয় মনোনয়ন পেতে আশাবাদী। তিনি এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। অবহেলিত আত্রাই- রাণীনগর এলাকায় বিগত বছরগুলোতে তিনি ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বিশেষ করে এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদ খ্যাত আত্রাই-রাণীনগরে তেমন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। স্বর্বহারাদের তৎপরতা দমন হয়েছে। এসব দমনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন বর্তমান এমপি ইসরাফিল আলম। তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে নৌকায় ভোট চাচ্ছেন। এ আসনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী নতুন যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন পি.কে আব্দুর রব এবং নওশের আলী। অপরদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন আনোয়ার হোসেন বুলু, এ্যাডভোকেট মাহমুদুর রহমান রজার মোল্লা, আমিনুল হক বেলাল ও ইছাহাক আলী।
