এস.এম আজিজুল হক, পাবনা : ‘নুরুন্নাহার’ কৃষিক্ষেত্রে স্বাবলম্বীতার জাতীয় মডেল এক নারী কৃষক। গ্রাম্য বধু নুরুন্নাহার; চার দেয়ালের গন্ডির মধ্যে যার নিরিবিলি জীবন-যাপন করার কথা, তিনি আজ রীতিমত একজন সফল নারী কৃষক ও উদ্যোক্তা। সবজি, বড়ই ও পেয়ারা চাষের পর তার গড়া গরুর খামারের সাফল্যে এখন অনেকেই উৎসাহী হয়ে উঠছেন। সফলতা ও দক্ষতায় জাতীয় কৃষি পদক পাওয়ার পর এবার তিনি বিনাখরচে বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য মনোনীত হয়েছেন। কৃষি কাজের আধুনিক প্রশিক্ষণের জন্য বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এনসিডিপির পক্ষ থেকে কিছুদিনের মধ্যে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন তিনি।
বসত বাড়ির আশপাশে নিবিড় সবজি চাষ করে এলাকাবাসীকে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। এনসিডিপি গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভানেত্রী নুরুন্নাহারের স্বামী রবিউল ইসলাম বিশ্বাস একজন ব্যবসায়ী। জয়নগরের চাউল কল মোকামের একটি মিলে ধান চাউলের ব্যবসা করেন। ৪ সন্তানের জনক-জননী রবিউল-নুরুন্নাহার। ছোট এই সংসার তাদের বেশ স্বাচ্ছন্দে চলে যায়। নুরুন্নাহার জানান, স্বামী কাজে বেরিয়ে গেলে একদম অলস বসে থাকা তার ভালো লাগত না। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠানে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শায়েখ সিরাজের পরিচালনায় কৃষি বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান দেখে তারও ইচ্ছে জাগে বসতবাড়ির আশপাশে শাক-সবজি ও ফলমূলের বাগান গড়ে তোলার। এরপর আর থেমে থাকেনি নুরুন্নাহার। অগাধ বিশ্বাসে অটল নুরুন্নাহার লোকলজ্জা ফেলে আত্মনিয়োগ করেন। বাড়ির আঙিনায় পতিত জমিতে শুরু করেন বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষ। লালশাক, পুঁইশাক, বেগুন, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় চাষ করেন। উৎপাদিত সবজি তার সংসারের সারা বছরের সবজির চাহিদা মিটানোর পর বাড়তি আয়েরও সুযোগ ঘটে। প্রথমে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থা নুরুন্নাহারের উৎপাদনমুখী ওই কর্মকান্ডে কিছুটা বাধার সৃষ্টি করলেও তিনি পিছুপা হননি। ২০০৫ সালে ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, জাকির হোসেন ও আব্দুর রশিদ নুরুন্নাহারের এলাকায় ব্র্যাক এনসিডিপি’র মহিলা গ্রাম কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটিতে নুরুন্নাহারকে কমিটি পরিচালনার দায়িত্ব দিলে তিনি নিজকর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন। এতে করে তার স্বামীর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বসতবাড়ির আঙ্গিনায় এবং বাড়ি সংলগ্ন ৫ বিঘা জমিতে ফুলকপি, বাধাকপি, ওলকপি, গাজর, ইত্যাদি ফসলের আবাদ করে আশাতীত লাভবান হন। পরের বছর ৩১ আগস্ট ঋণ পরিশোধ করে দ্বিতীয় বারের মত ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। এ অবস্থায় তিনি জানতে পারেন বড়ইচারা দক্ষিণপাড়ায় ছিদ্দিকুর রহমান ময়েজের কূল চাষ প্রকল্পের কথা। ময়েজের কাছ থেকে চারা কিনে নিয়ে নুরুন্নাহার ১শ ৭৫টি গাছের একটি কূল বাগান গড়ে তোলেন। প্রথম বছর কূল বিক্রি করে তিনি ২৫ হাজার টাকা আয় করেন। এছাড়া উন্নত জাতের পেয়ারার ৪০টি গাছও লাগানো হয় আঙ্গিনায়। এরই ধারাবহিকতায় কর্মোউদ্যমী এই নারী কঠিন পরিশ্রম ও নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে কৃষি খামারে উন্নত জাতের ৫০টি গরুর একটি খামার গড়ে তুলেন। দেশের সকল নারী কৃষককে ডিঙ্গিয়ে ২০১০ সালে ঈশ্বরদীর নুরুন্নাহার সিটি গ্র“প জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। এতে নগদ সাড়ে ৩ লাখ টাকা, একটি সার্টিফিকেট এবং একটি ২৪ ইঞ্চি রঙ্গিন টেলিভিশন পুরস্কার তাকে দেয়া হয়। এরপর নুরুন্নাহারের জয়-জয়কার ছড়িয়ে পড়ে গোটা পাবনা জেলায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নুরুন্নাহারের কাছে কৃষিকাজের পরামর্শ নিতে ছুটে আসেন অনেকেই। নুরুন্নাহারও তাদের মাঝে ছড়িয়ে দেন তার সফলতার দিকগুলো।
নুরুন্নাহার নিজেকে দক্ষ কৃষক হিসেবে গড়ে তোলেই থেমে থাকেননি। তার গ্রামের ২শ নারীকে হাতে-কলমে কৃষি কাজের প্রশিক্ষনও দিয়েছেন। ২০১১ সালে দেশের সেরা নারী কৃষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়ে তিনি দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দেন। নুরুন্নাহারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফল নারী উদ্যোক্তা ও নারী কৃষক নুরুন্নাহারের হাতে তুলে দেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক। নুরুন্নাহার জানান, উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন। সহজ শর্তে এবং কম সুদে ব্যাংক ঋণের সুবিধা পেলে নুরুন্নাহার তার আবাদি জমির পরিমাণ আরও বাড়াবেন। ঘরের গৃহিণী থেকে নুরুন্নাহার এখন কেবল একজন সফল নারী উদ্যোক্তা ও নারী কৃষকই নন, তিনি কৃষিক্ষেত্রে এক জাতীয় মডেল। স্বাবম্বীতার নতুন মুখ।
