শাহ আলম বাবুল/মো. ফরিদুজ্জামান : চিরায়ত গ্রাম বাংলার অপরুপ সৌন্দর্যে বেড়ে ওঠা রূপালীরা কৈশোর না পেরুতেই বসে যায় বিয়ের পিড়িতে। পিতা-মাতার একান্ত বাধ্যগত এসব সুবোধ বালিকাদের অধিকাংশই তখনও বুঝেইনা সংসার কি? বিয়ে কি? অথচ মুখ বুজে বাবা-মায়ের ইচ্ছের ছুরির নীচে মাথা নুইয়ে দেয় তারা। এখনও প্রতিনিয়ত ঘটছে এমন ঘটনা গোচরে-অগোচরে।
শিক্ষাহীনতার গহীন অন্ধকারে বসবাস করতে করতে বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে উন্নয়নের ছোঁয়া অনেকাংশেই মলিন এসব রূপালীদের পরিবারে। এ যেন বাল্যবিয়ের অভিশপ্ত এক বালিকার করুণ কাহিনী। নিভৃত পল্লী মামদামারী। শেরপুর জেলা থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে শ্রীবরদী উপজেলায় এই নিভৃত পল্লীর অবস্থান। এখানেই বাস করে করুণ গল্পের নায়িকা রূপালী।
একই গ্রামের বাবা মৃত সিরাজুল ইসলাম সদি মিয়া ও মা জবাকুলের ৪ কন্যা সন্তানের সর্ব কনিষ্ঠ রূপালী। দিনমজুর পিতা মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সংসারে টানাপোড়েনে বিদ্যালয়ের আঙ্গিনা পর্যন্ত যাওয়া হয়নি রূপালীর। সংসারের বোঝা কমাতে মাত্র ১২ বছর বয়সেই একই গ্রামের কর্মক্ষম টগবগে তরুন শফিকুলের কাছে বিয়ে হয় রূপালীর। রূপালীকে বিয়ে দেওয়ার পর বাবার সংসারের বোঝা কমলেও নিজের সংসারের বোঝা বাড়তে থাকে রূপালীর। যে বয়সে আর দশটি মেয়ে স্কুল কলেজে যায়, বাবা-মার সংসারে রঙ্গীন স্বপ্ন বুনে, ঠিক সেই বয়সে রূপালীর জীবনে নেমে আসে সংসার নামক এক অপরিপক্ক জীবনের কালো ছায়া। বয়স ২২ পেরোতে না পেরোতেই একে একে ৫ সন্তানের জন্ম দেয় রূপালী। সংসার বাড়ে, বাড়ে সংসারের খরচ। সংসারের ৫ সন্তানের দু’বেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হয় স্বামী শফিকুলকে। প্রথম সন্তান রিপন (৮) এখনো বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় যায়নি। দ্বিতীয় স্বপ্না (৭) তৃতীয় রতœা (৬) চতুর্থ মুক্তা (৪)- এদেরও একই অবস্থা। আর রিক্তা (২) বর্তমানে দুগ্ধপোষ্য শিশু। শিশু সন্তানের মুখে একফোটা দুধ আর বাকি ৪ সন্তানের দু‘বেলা দুমুঠো খাবার যোগাতে রিক্সা চালানোর আয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পডে শফিকুলের। বাধ্য হয়েই অধিক রোজগারের আশায় পাড়ি জমায় ঢাকায়। এক মাস রি´া চালিয়ে কিছু উপার্জন সে করেও ছিল। কিন্তু বিধির কি বিধান, তা নিয়ে তার আর বাড়ী ফেরা হয়নি। বিয়ের ১১ বছরের মাথায় এসে সেই টগবগে যুবক পিতা হঠাৎ করেই পাড়ি জমান পরপারে। নিজের বলতে স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য খড়ের ঘর থাকা জায়গাটুকুই তার সম্বল। এ ভাঙ্গা ঘরেই ৫ সন্তান নিয়ে নানা দু:খে-কষ্টে দিনাতিপাত করছে রূপালী। কাজের খোজে হন্যে হয়ে ঘুরে রূপালী, বয়স আর সন্তানের বাড়তি বোঝায় কেউ তাকে কাজও দিতে চায় না। গেল ঈদে এলাকার হৃদয়বানদের সহায়তায় কিছু অর্থ জোগাড় হয়েছিল আর তা দিয়েই চলছে ক‘দিন, কিন্তু তারপর ? তার আর পর নেই—-। এখন রূপালীর চারদিকে শুধুই ঘোর অন্ধকার।
বাল্য বিয়ের করুণ পরিণতির শিকার এইসব রূপালীদের ভাগ্য বিড়ম্বনা ঘোচাবে কে? দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত সংসারের বোঝা কমাতে কৈশোর না পেরোতেই রূপালীদের পাত্রস্থ করে নিজেকে যারা কিছুটা হালকা করে নেয়, রূপালীদের করুণ পরিণতির দায় কি শুধু তাদেরই? না, এই করুণ পরিণতির দায়বদ্ধতার সমীকরণে দায় ঘোচানোর সুযোগ নেই সমাজ ও রাষ্ট্রের। এখনই প্রয়োজন এই দায়বদ্ধতা ঘোচাতে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে রূপালীদের পাশে দাড়ানোর। নিদারুণ কষ্টের কারণে রূপালীর গর্ভজাত ৫ সন্তান যেন ঝড়ে না যায়, তারা যেন কোনোমতে খেয়ে-পড়ে শিক্ষার আলো পায়- এমন ব্যবস্থা বা দায়িত্বটা আমরা কি কেউ নিতে পারিনা?
