‘গণধোলাইয়ে নাকাল পকেটমারকে বাচালেন বিচারক’- এমন একটি খবর শ্যামলবাংলাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ওই খবরে বলা হয়েছে, ২৯ জুলাই সোমবার বিকেলে শেরপুর জেলা শহরের হাজী মার্কেট সংলগ্ন গাঙ্গিনারপাড় মোড়ে পকেটমারীর অভিযোগে জনতা পাকড়াও করে ছাইফুল ইসলাম (২০) নামে এক পকেটমারকে। পরে ওই পকেটমারের উপর একে একে ঝাপিয়ে পড়ে জনা বিশেক পথচারী জনতা। উপুর্যপরি উত্তম-মধ্যমে ওই পকেটমার নাকাল ও নিস্তেজ হওয়ার পরও যখন জনতা থামছিল না, ঠিক তখন ওই রাস্তায় আদালত থেকে গাড়ীযোগে বাসায় ফিরছিলেন শেরপুরের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ সেলিম মিয়া। ঘটনাস্থলে পৌছে তার গাড়ী থেমে যায়। গাড়ী থেকে নেমে সঙ্গে থাকা পিয়নকে নিয়ে তিনি জনতাকে বুঝিয়ে শান্ত ও নিবৃত করেন। একই খবরে সচেতন মহলের মতামত উদ্বৃত করে বলা হয়েছে, কেবল বিচারকের মহানুভবতা ও সাহসের কারণেই জনতার হাতে পাকড়াও ও গণধোলাইয়ের শিকার পকেটমার ছাইফুল ইসলাম মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। এছাড়া শ্যামলবাংলার অপর এক খবরে প্রকাশ, ১ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাতে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার গেরামারা কবরস্থানে লাশ চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে সেন্টু মিয়া (২৫) নামে লাশ চোর চক্রের এক সদস্য।
কেবল ছাইফুল ও সেন্টু মিয়ার ক্ষেত্রেই নয়, ওই ধরনের গণধোলাইয়ের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে হাটে-বাজারে, বন্দরে-শহরে। ওইসব গণধোলাইয়ের কবলে যে কেবল অপরাধী বা চোর, পকেটমার, ছিনতাইকারী, ডাকাতকেই পড়তে হয় ঠিক তা নয়। ঢাকার সাভারের আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে গণধোলাইয়ে ৬ শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা আমাদেরকে সেটাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ কথা সত্য যে, আইনী ব্যবস্থার পুন:পুন: সংস্কারের পরও পকেটমারী, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ কিছু অপরাধ নির্মূলতো হচ্ছেই না, বরং তা কোন কোন ক্ষেত্রে বেড়েই চলেছে। একসময় অভাব, ক্ষুধা ও দারিদ্রতার কাধে ভর দিয়ে ওইসব অপরাধের চর্চা-অনুশীলন হলেও এখন দেশের সার্বিক অথনৈতিক উন্নয়নের সুবাদে মানুষের দিন-মানেরও পরিবর্তন হয়েছে। তারপরও সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ ওইসব অপরাধ নামক সেকেলে সামাজিক ব্যাধি-সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না। এর মূলে রয়েছে আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সচেতনতার অভাব, অশিক্ষা। সর্বোপরি আইনী সচেতনতার অভাব ও আইনী প্রয়োগের অপব্যবহারও ওই অবস্থার জন্য কম দায়ী নয়।
অপরদিকে গণধোলাই বা গণপিটুনিও আমাদের সমাজে সেকেলে এক সামাজিক অপরাধ বা ব্যাধি। পকেটমার, চোর, ছিনতাইকারী, ডাকাতরা এর শিকার হন বেশি। তবে সর্বাধিক নাজুক অবস্থায় পড়তে হয় পকেটমারকেই। কারণ এরা থাকে নিরস্ত্র। কোনরূপ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ক্ষমতা তাদের থাকেনা। অবশ্য ক্ষেত্রমতে নির্দোষ ব্যক্তিও এই পরিস্থিতির শিকার হন। হূযোগ উঠলেই হলো। ‘ধর,ধর! পকেটমার, চোর চোর’… শব্দ শুনলেই হলো। স্বাস্থ্যবান, সুস্থ্য যে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, অন্তত: একটি লাথি, কিল, ঘুষি, থাপ্পড় দিতেই হবে। অথচ চোখের সামনেই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী-ছিনতাইকারী অপরাধ ঘটিয়ে গেলেও প্রতিরোধে এগিয়ে যায় না কেউ। আর বিশেষত: পকেটমারদের ক্ষেত্রে বিক্ষুব্দ ভয়াবহ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ দূরে থাক, উত্তেজিত-উৎসুক জনতাকে নিবৃত করার মতও কোন অবস্থা সৃষ্টি হয় না। বিচারকের হাত দিয়ে রক্ষা পাওয়া নাকাল পকেটমারের মত ভিন্নরূপ প্রেক্ষাপট ছাড়া নির্মম মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করতে হয় ওই ব্যক্তিকে।
একসময় অন্যায়কারীকে সামাজিক বয়কটসহ নানাভাবে অপমানিত করা হত, তার মাঝে ঘৃণাবোধ সৃষ্টির জন্য। এর মধ্যে মাথার চুল কাটা, মুখে চুনকালি, গলায় জুতার মালা, জুতাপেটা, থুথু চাটানো, নাকে খত, নাকে পানি ঢালা প্রভৃতি। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে ওইসব শাস্তির নামে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আজ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
এরপরও গণধোলাই নামক সেকেলে সংস্কৃতি থেকে আমরা এখনও বেড়িয়ে আসতে পারিনি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আর সভ্য সমাজে এখন ওই সেকেলে সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বেড়িয়ে আসতে হবে। গণধোলাই এখন কেবল এক সেকেলে সামাজিক ব্যাধি ও অপরাধই নয়, এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও অন্যতম প্রধান উদাহরণ। যা আধুনিক, সভ্য ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় চলতে পারে না কিংবা মেনে নেয়া যায়না। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে/আমজনতাকে যেমন সচেতন করে তুলতে হবে, তেমনি জনসাধারণের মাঝে আইনশৃংখলা বাহিনীর উপর আস্থা আরও বাড়াতে হবে। এজন্য যে মানুষের মাঝে সেই মজ্জাগত ধারণা ‘পুলিশ দিয়ে কিছু হবে না, তার চেয়ে নিজেরাই যা করা যায়’ এখনও কাজ করে। অথচ আইন লঙ্ঘন করা বা ফৌজদারী কোন অপরাধ করা আর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া একই কথা- এই পরিবর্তন তাদের মাঝে কাজ করছে না। পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা মাঠ পর্যায়েও কাজ করছে। কিন্তু তাদের দ্বারা এই প্রাগৈতিহাসিক-সেকেলে সামাজিক ব্যাধি দূরীকরণে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কোন কর্মসূচি হাতে নিতে দেখা যাচ্ছে না। আমরা আশা রাখব হাম, পোলিও, ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ রোগের মত অনেক কঠিন রোগ নির্মূলের মধ্য দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান যখন মরণব্যাধি ক্যান্সার নিরাময়েও অনেকটাই অগ্রসরমান, সেক্ষেত্রে গণধোলাই সংস্কৃতি নির্মূলে আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনীর পাশাপাশি সরকারের তথ্যবিভাগ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের যৌথ উৎযোগে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির একটি আন্দোলন দরকার। এজন্য শহরে-বন্দরে, হাট-বাজারে আর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জনসচেতনতামূলক স্লাইডশো, পথসভা ও নাটিকা মঞ্চায়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। শুরু হোক সেই আন্দোলন, আর আমরা বেড়িয়ে আসি গণধোলাই সংস্কৃতি থেকে- পরিবর্তিত অবস্থায় এই প্রত্যাশাই আমাদের।

লেখক : সম্পাদক, শ্যামলবাংলা২৪ডটকম।
ই-মেইল : press.adhar@gmail.com
