জুবায়ের রহমান/ফরিদুজ্জামান :
পাহাড়ের পাদদেশে কলকল ছলছল কলরব তুলে অবিরাম ধারায় ঝরে চলেছে টলটলে স্বচ্ছ ঝরণার জল। দু’ধারে উচুনিচু সবুজ অরণ্যবেষ্টিত টিলা, প্রকৃতির সবুজ বনায়ন, পাখপাখালির কুঞ্জনে মুখরিত এ জনপথ যেন পরিণত হয়েছে ঐশ্বরিক স্বপ্নপুরীতে। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেশের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত ঐতিহাসিক গারো পাহাড়। প্রকৃতির গভীর মমতা ও ভালোবাসায় সিক্ত শেরপুর জেলাধীন শ্রীবরদী উপজেলার প্রত্যন্ত আদিবাসী পল্লী বাবেলাকোনা, হারিয়াকোনা, দার্শিকোনা, চান্দাপাড়া, মেঘাদল ও মারাকপাড়াসহ প্রায় ২০/২৫টি গ্রাম।
ওইসব গ্রামগুলো প্রায় ৩শ বছরের পুরোনো হলেও আজকের এই ডিজিটাল যুগে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও এখানে বসবাসরত আদিবাসীদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। নেই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা অর্জনের মত পর্যাপ্ত সুযোগ। নেই স্বাস্থ্যসেবামূলক কোন প্রতিষ্ঠান। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা। আজও বিদ্যুতায়িত হয়নি এসব গ্রাম। এছাড়া যাতায়াতের জন্যে নেই কোন ভাল রাস্তাঘাট। তবে ১৯৯০ সালে দেশের সীমান্তবর্তী উপজেলা শ্রীবরদী সদর থেকে কর্র্ণঝোরা এলাকা পর্যন্ত মাত্র ২৫ কিলোমিটার একটি রাস্তা নির্মিত হয়। সেইসাথে তৎকালীন জামালপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড়ী জনপদে লাওচাপড়া নামক স্থানে গড়ে তোলা হয় একটি মনোরম অবকাশকেন্দ্র। ফলে শুরু হয় দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটকের আনাগোনা। আসতে থাকে সংস্কৃতিমনা হাজারও লোকজন। প্রকারান্তে শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটে শিক্ষা বঞ্চিত পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর। ফলে তারা শিক্ষার অভাববোধ করতে থাকে। ঠিক এমনি সময় ১৯৯০ এর শুরুর দিকে হ্যামেলিয়নের বাঁিশওয়ালারূপে আবির্ভূত হন ‘ওর্য়াল্ড ভিশন অব বাংলাদেশ’ কাপিল প্রকল্পের জনৈক কর্মকর্তা ফ্রান্সিস হালদার। তিনি আদিবাসী তথা পাহাড়ীদের জীবনমান ও শিক্ষার উন্নয়নে ‘শিক্ষার বিকল্প নেই’ শ্লোগানকে ধারণ করে শুরু করেন শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিষয়ক জনসচেতনতামূলক কাজ। অল্প সময়েই পাহাড়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের মাঝে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সমর্থ হন তিনি। স্থানীয় সুশীল নকরেক, ভূপেন মান্দা, অমৃত অর্মী, প্রাঞ্জল এম সাংমা, কর্ণিয়া সাংমাসহ ১৫/২০ কর্মউদ্যমী মানুষকে সাথে নিয়ে এলাকার সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও উন্নত জীবনমানের হাতিয়ার হিসাবে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। এরই অনন্য প্রকাশ ‘বাবেলাকোনা আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়’। বিদ্যালয়টি যেন সারি সারি উচুনিচু পাহাড়ের মাঝে এক খন্ড মেঘ শোভিত অনিন্দ্য অবকাশ। শিক্ষাবঞ্চিত অন্ধকারাচ্ছন্ন পাহাড়ের মাঝে একটি জ্বলন্ত দ্বীপশিখা। ঝরণার রূপালী প্রবাহ আর আদিগন্ত বিস্তারী সবুজ শ্যামলিমায় নয়নাভিরাম পরিবেশে এলাকাবাসীর অর্থসাহায্যে ক্রয়কৃত ৭৫ শতাংশ জমিতে ১৯৯০ সালে ফ্রান্সিস হালদারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত আদিবাসী জুনিয়র স্কুলটি অনিন্দ্য সুন্দরের হাতছানি। শিক্ষা অনুরাগী মানুষ ফ্রান্সিস হালদারের ওই মহান-মহৎ উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের মুখ দেখে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ওর্য়াল্ড ভিশন অব বাংলাদেশের সহযোগিতায় দুটি টিনের ঘর নির্মাণ করে ৭ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ অল্প কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে। এমতাবস্থায় ১৯৯৫ সালে আদিবাসী ওই বিদ্যালয়টি তৎকালীন স্থানীয় এমপি মাহমুদুল হক রুবেলের সুনজরে আসলে তা ৭ জন শিক্ষকসহ বিদ্যালয়টি নিুমাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভূক্তি হয়। এরপর মাহমুদুল হক রুবেল দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্টের অর্থায়নে ১৭ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে একটি পাকা ভবন নির্মিত হয়। পরে প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্সিস হালদারের ্আপ্রাণ চেষ্টায় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ওর্য়াল্ড ভিশন অব বাংলাদেশ ২০১১-১২ অর্থবছরে তারাও ওই সমপরিমান অর্থব্যয়ে অপর একটি ভবন নির্মান করে দেওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাশরুমের সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টির ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩শ ৩৬ জন। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ১০ জন। তবে সর্বশেষ নিয়োগপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহেল মুফতি, মাহবুব আলম ও আমিনুল ইসলাম- এদের এখনও এমপিও হয়নি। তারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দীর্ঘদিন যাবত পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন।
শ্যামলবাংলা থেকে সরেজমিনে গেলে কথা হয় বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কর্ণিয়া সাংমার সাথে। তিনি শ্যামলবাংলাকে জানান, প্রতিষ্ঠাকাল হতেই বিদ্যালয়টি বেশ সুনাম কুড়ালেও নানাবিধ সমস্যায় নিমজ্জিত। নেই পর্যাপ্ত ক্লাশরুম। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের গাদাগাদি করে বসতে হয়। নেই ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার নির্ধারিত মাঠ, খেলাধুলার সরঞ্জামাদি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। নেই মেয়েদের জন্যে আলাদা কমনরুমের ব্যবস্থা। নেই বিজ্ঞানাগার। নেই পাঠাগার। নেই চিত্তবিনোদনের কোন সু-ব্যবস্থা। নেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। এত সমস্যার মাঝেও বিদ্যালয়টি বিভিন্ন সামাজিক ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জাতীয় প্রোগ্রামগুলোতে অংশ নিয়ে ধারাবাহিক সাফল্যের স্বাক্ষর বহন করে চলছে। তিনি মনে করেন, বিদ্যালয়টিতে আরও নতুন ভবন নির্মাণ, বাকী ৩ জন শিক্ষকের এমপিও ভুক্তিকরণসহ বিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার প্রসারে এখনই দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি খুবই বেশি প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয়টি দশম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত হলে ঝড়ে পড়ারোধ, বাল্যবিবাহ বন্ধে বিদ্যালয়টি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। বাড়বে উচ্চ শিক্ষার হার। কথা হয় বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সমাজকর্মী প্রাঞ্জল এম সাংমার সাথে। তিনি জানান, ১৯৯০ সালের পূর্বে এই আদিবাসী অধ্যুষিত অবহেলিত পাহাড়ী নিভৃত পল্লীতে কোন বিদ্যালয় ছিলনা। সংগত কারণেই হতদরিদ্র ছন্নছাড়া এই জনপদের মানুষগুলোর মাঝে পুথিপাঠের কোনপ্রকার প্রভাবও পড়েনি। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই ছিল নিরক্ষর। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর আদিবাসী তথা অপরাপর জনগোষ্ঠীর প্রায় শ’খানেক ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের বিভিন্ন দপ্তরে চাকুরী-বাকুরীতে কর্মরত আছেন। বাবলাকোনা, হারিয়াকোনা, দার্শিকোনা, চান্দাপাড়া, মেঘাদল ও মারাকপাড়াসহ প্রায় ২০/২৫টি গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখানে লেখাপড়া করতে আসে। বর্তমানে এসব গ্রামে ৮৫ ভাগ ছেলেমেয়ে নিরক্ষরতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। ওইসব এলাকার ৯০ ভাগ মানুষ কৃষিতে জীবন ধারণ করায় চরম দারিদ্রহীনতায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া খরচ বহনে হিমশিম খাচ্ছে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিদ্যালয়গামী ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তির আওতায় আনয়ন সেইসাথে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারে গরিব মেধাবী ছাত্র ছাত্রীর অভিভাবকদের সরকারী অর্থ সাহায্য ভিজিডি ভিজিএফের আওতায় আনা হলে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই নিভৃত পল্লীতে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন অব বাংলাদেশ, পিদিম, কারিতাস, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান দারিদ্র বিমোচন কল্যাণ সংস্থা শিক্ষার ব্যাপক প্রসারে এই জনপদে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এদের পাশাপাশি সরকারী সংস্থাগুলো এগিয়ে আসলে পাহাড়ী নৃ-জনগোষ্ঠী আদিবাসীদের ভাষা সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, ঐতিহ্য ও অধিকার বাস্তবায়নে সহজ হবে।
আদিবাসীদের মাতৃ সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন (টিডাব্লিউএ) এর চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা ও আদিবাসী জুনিয়র স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুশীল নকরেক এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, আদিবাসীরাও দেশমাতৃকার টানে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অনন্য অবদানের স্বাক্ষর স্থাপন করলেও তারা আজ নিগৃহীত নিপীড়িত। তিনি বলেন, এ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে বসবাসকারী গারো হাজংদের জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক রূপবৈচিত্র্য দেশের অন্যান্য নৃ-জনগোষ্ঠীর থেকে কিছুটা আলাদা ও স্বতন্ত্র। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের রীতি রেওয়াজ ও সামাজিকতা এর মূল কারণ। দারিদ্রতার কষাঘাতে জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেকেইে বনভিত্তিক জীবন ছেড়ে নানা পেশার তারে ও আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠায় ও শিক্ষালাভে যথাযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পার হতে পারছে না তারা। আবার বাড়িতে বসেও দুবেলা দু’মুঠো ভাত জুটছে না তাদের। ফলে আদিবাসী তরুণীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বল্প বেতনে বিউটি পার্লারে ও বিদেশী দূতাবাসসমূহে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। লেখাপড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে। তিনি আরও বলেন, ঝড়ে পড়ারোধে এবং তরুণ-তরুণীদের উচ্চ শিক্ষায় আকৃষ্ট করতে শিক্ষানুরাগী হ্যামেলিয়ানের বাঁশিওয়ালারূপী ফ্রান্সিস হালদারের মত শিক্ষামূলক সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে সমাজ তথা সরকারকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। অবহেলিত জনপদে দারিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার কথা ভেবে অন্ধকারে আলোর প্রদীপ জ্বালাতে মহৎ ও মহানুভব মানুষ ফ্রান্সিস হালদার ওই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রত্যন্ত পল্লীতে সমাজে শিক্ষা সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোতে আলোকিত করার এই মহান প্রয়াস অত্যন্ত প্রশংসণীয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার দলকে ভালবাসলেও আওয়ামী সরকারের আমলে আদিবাসী জুনিয়র বিদ্যালয়টি দশম শ্রেণীতে উন্নীত করার ব্যাপারে স্থানীয় এমপি ফজলুল হক চাঁনের দ্বারস্থ হয়েও কোনপ্রকার সুফল পাননি। এ অবস্থায় স্থানীয় অবহেলিত জনগোষ্ঠী বিদ্যালয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দশম শ্রেণীতে উন্নীত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।

প্রতিবেদক : বার্তা সম্পাদক ও স্টাফ রিপোর্টার, শ্যামলবাংলা।
