পৃথিবী থেকে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটেছে অনেক আগে। রাজতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল, অনেক রক্ত ঝরেছিল। রাজতন্ত্রেও অন্যতম শর্ত ছিল শত অত্যাচার শত শোষণ নির্যাতনের পরও রাজার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রদর্শন। আনুগত্যেও ঘাটতি বা কমতি নিয়ে রাজার রাজ্যে বসবাস করা যেতনা। রাজতন্ত্রের সব চেয়ে কালো দিক ছিল যুবরাজদের কর্মকান্ড ও খামখেয়ালীপনা। যুবরাজদের পছন্দ অপছন্দ ও চাওয়া পাওয়ার মুল্য দিতে গিয়ে প্রজাদেরকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে হয়েছে। প্রজাদের মঙ্গল অমঙ্গলের চাইতে যুবরাজদের চাওয়া পাওয়াকে সব সময় বেশী গুরুত্ব দেয়া হতো। কারন যুবরাজ বলে কথা। যুবরাজদের এত গুরুত্বকে অনেক টাউট বাটপার কাজে লাগিয়ে নির্বিঘেœ তাদের লুটপাট ও অপকর্ম চালিয়ে যেত। যুবরাজ বলে যেমন কথা, ঠিক তেমনি যুবরাজদের লোক বলেও কথা। রাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রজারা রাজা কর্তৃক যতটা নির্যাতিত হতো, তার ঢেড় বেশী নির্যাতিত হতো যুবরাজ ও তার বন্ধুদের দ্বারা। যুবরাজরা অবশ্য কখনও দুর্নীতি করে নাই। কারন তাদের দুর্নীতি করার প্রয়োজন পড়ে নাই। তারা যা করতো, তা প্রকাশ্যে জোড়জবরদস্তি করেই করতো। দুর্নীতি গোপনে এবং অত্যন্ত কৌশলে করতে হয়। দুর্ণীতি করে ধরা পড়লে বিচার হয়, সাজা হয়। রাজার ক্ষমতায় ক্ষমতাবান যুবরাজদেও যেহেতু সাজার ভয় নাই, সে হেতু তারা দুর্ণীতি না করে, প্রকাশ্যে তাদের ইচ্ছা ও চাওয়া পাওয়ার সমন্বয় ঘটায়। ক্ষেত্র বিশেষে যুবরাজদের তাও প্রয়োজন পড়ে না। কারন তাদের ইচ্ছা পুরনের জন্য একদল চামচা সদা প্রস্তুত থাকে। অবশ্য ইতিহাসে অনেক যুবরাজদের কথাও শোনা যায়, যারা প্রজার পক্ষ নিয়ে রাজপিতার বিরুদ্ধাচরণও করেছে। জানিনে আমাদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে। রাজতন্ত্র আর পরিবারতন্ত্রের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। রাজতন্ত্রে আর যাই হোক না কেন-প্রজার প্রশ্নটি থেকেই যায়। কিন্তু পরিবারতন্ত্রে প্রজার প্রশ্নটি থাকে গৌন রুপে। পরিবারতন্ত্রে পরিবারের মান, পরিবারের প্রতিপত্তি, পরিবারের অস্তিত্বর প্রশ্নটি বড় করে দেখা হয়ে থাকে। ইতিহাস অন্তত তাইই বলে। গনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বা গনতান্ত্রিক রাজনীতিতে নেতা সৃষ্টি হয় তৃণমুল থেকে। অনেক ঘাত প্রতিঘাত, চড়াই উৎড়াই, জেল জুলুম নির্যাতন ইত্যাদীর পাঠ চুকিয়ে খাটি সোনা হয়ে নেতা সৃষ্টি হয় গনতান্ত্রিক রাজনীতিতে। সেই রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটলে গোটা গনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়ে। বঙ্গবন্ধু বা মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে জাতীয় ৪ নেতাসহ অনেক বিদগ্ধ রাজনীতিকদের কথা ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে চিরদিন। আর এসব নেতার কেউই পরিবারতন্ত্রের শ্রোতে ভেসে আসেননি বা আমলাতান্ত্রিক আশির্বাদপুষ্ট হয়েও আসেননি। রাজতন্ত্রের পতনের পর রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব যে কতটা খারাপ হতে পারে, তা অবলোকনের জন্য বিশ্বের দিকে না তাকিয়ে দেশের রাজনীতির অঙ্গনের দিকে তাকালেই সম্যক ধারণা পাওয়া যেতে পারে। পারিবারিক যুবরাজদের দুর্নীতির দিকে আলোকপাত না করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে তাকালে আমরা কি দেখি? যারা জনকল্যানের কথা চিন্তা করে, দেশের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে নিজেদের সংসারের দিকে না তাকিয়ে, স্ত্রী পুত্র পরিজনের কথা ভুলে গিয়ে জেল জুলুমসহ শত অত্যাচার সহ্য কওে, সর্বস্ব ত্যাগ করে আজ বার্ধক্যের কোঠায় এসে পৌছেছে-সেই তারাই আজ পিছনের সারির রাজনীতিক হিসেবে রাজনৈতিক দলে বিবেচিত হয়। ত্যাগী রাজনীতিকদের এমন হাল মোটেই শুভ কিছুর ঈঙ্গিত দেয়না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এমনটি ছিলনা।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা, বহুদলীয় গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে যেয়ে রাজনীতিতে ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ আমলা ও স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দেয়ায় বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন রাজনীতি কলুসিত হয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বিদগ্ধ রাজনীতিকদের বিতারন করা হয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে। বর্তমান সরকারের এমপি মন্ত্রীরা সবাই গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিজেদের যোগ্যতা প্রমান করেই নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একইভাবে যোগ্যতা প্রমান করে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের গ্রহন যোগ্যতা ও তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অর্থ তাদেরকে অযোগ্য ভাবা এবং তাদের যোগ্যতাকে অবমুল্যায়ন করা। আর এই কাজটিই আমাদের দেশে বেশ জোরেসোরে করা হয়েছে। প্রায় সকল মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর পিছনে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে সারা জীবনের গণবিচ্ছিন্ন আমলাদের। এই প্রক্রিয়াকে উপদেষ্টার মোড়কে অবিশ্বাসের উলঙ্গ প্রকাশ বৈ আর কি বলা যেতে পারে? ফলাফল যা হবার, তাইই হচ্ছে। উপদেষ্টাদের বেসুরো কথাবার্তার সাথে সুর মিলিয়ে আজ অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন মন্ত্রী পরিষদের অনেক সদস্য। একই রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়ে, একই সরকারের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হয়ে কথাবার্তা বলছেন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন সুরে। গান গাইতেও যন্ত্রীদের সুর মিলাতে হয়, তাল মিলাতে হয় অথচ সরকারের মন্ত্রী এমপিদের কথা বলতে সুর তাল লয় লাগেনা। বলে ফেলতে পারলেই ব্যস। যে যা খুশি মনে করুক, তাতে ওনাদের যেন কিছু যায় আসেনা। ঠিক এই অবস্থায় আমাদের দেশের রাজনীতিতে যুবরাজদের আগমন ওই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কথাবার্তা বলার মাত্রা নিঃসন্দেহে আর এক ধাপ বাড়িয়ে দেবে। মায়েদের পায়ের নিচে যে সন্তানেরা বেহেস্ত খুজে পায়নি-ভাইদের পায়ের নিচে তারা কি পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখন আর শুধু জী ম্যাডাম বা জী আপা বলে নেতৃত্ব ধরে রাখা যাবেনা, বিপদে আপদে পার পাওয়া যাবেনা। এবার ওই জী ম্যাডাম, জী আপার সাথে জী যুবরাজ যোগ করতে হবে। বিগত সাড়ে ৪ বছরে জাতি দেখেছে-জী ম্যাডামের সাথে জী যুবরাজ জী যুবরাজ বলতে বলতে অনেক পোড় খাওয়া বিদগ্ধ রাজনীতিক নির্লজ্জের মত মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। সম্প্রতি শুরু হয়েছে জী আপার সাথেও জী যুবরাজ জী যুবরাজ বলার প্রতিযোগিতা। মুকুটহীন সম্রাটের দেশের রাজনীতিতে এ কিসের আলামত? স্বাধীনতা পুর্ব এই দেশের রাজনৈতিক নেতা মওলানা ভাসানী হয়ে উঠেছিলেন আফ্রো এশিয়া ল্যাটিন আমেরিকার শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা। পাকিস্তানী শাসকদের শাষিত পুর্ব পাকিস্তানের মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা গোটা বিশ্ব জাহানের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুখে মুখে ছিল সেদিন। সেই নেতাদের স্বপ্নের সোনার বাংলার রাজনীতির এ কি হাল হয়েছে আজ। জানিনে, যুবরাজদের আগমনে আর কি হাল হবে এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের। পরিবারতন্ত্রের পাকাপোক্ত ব্যবস্থার সাথে জনকল্যানের সামান্য আবেদন সংযোজিত হলেও মুকুটহীন সম্রাটের বিদেহী আত্মা অন্তত একটু শান্তি পাবে।
যুবরাজদের মায়েদের মধ্যেকার পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ বিরোধ যে ভাবে দুই ঘরানাকে কলুশিত করেছে, জাতীর প্রত্যাশা-যুবরাজরা সেই অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে এসে দেশকে আলোকিত করবে, জাতীকে আশা দিবে, জাতিকে ভরসা দিবে, জাতিকে নির্বিঘেœ ঘুমাতে দিবে, মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিবে, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থা উপহার দেবে, পরমত সহিষ্ণু গনতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবর্তন করবে, সত্যকে সত্য বলবে, মিথ্যাকে মিথ্যা বলবে, চোরকে চোর বলবে, সাধুকে সাধু বলবে, ঘুষখোরকে ঘুষকোর বলবে এবং এগুলো বলা এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের নজির সৃষ্টি করবে। যুবরাজদের কাছ থেকে জাতি পরমত সহিষ্ণু আচরণ আশা করে, ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে সোনার বাংলা গড়ার আহবান প্রত্যাশা করে। মানচিত্রে স্বাধীন বাংলার ছবি স্থাপনে এবং সবুজের বুকে লাল সূর্যাঙ্কিত পতাকা উড়াতে যাদের জীবন গেছে, যে মায়ের সম্ভ্রম গেছে, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে নতুন ইতিহাস রচনায় যুবরাজেরা আত্মনিয়োগ করলে জাতী তাদেরকে সুস্বাগতম জানাবে। অসহিষ্ণু ও অস্থির রাজনীতির অবসান কল্পে বাংলার রাজনীতিতে যুবরাজদের সুস্বাগতম।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট, পাবনা।