ইতিহাস ও সভ্যতার হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় ত্রাসের পরিণতি ও বলপ্রয়োগের পরিণাম শুভ হয়নি। হাবিল-কাবিলের ঘটনা থেকে ফেরাউন-নমরূদ বা আধুনিককালের হিটলার-মুসোলিনি-স্ট্যালিন-ইরানের শাহ-পলপট কেউই শক্তির দাপটে টিকে থাকতে পারেনি। প্রতিপক্ষকে নিষিদ্ধ, বঞ্চিত ও আক্রমণ করেও স্বৈরাচারীরা নিজেদের শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি। সোভিয়েট কমিউনিস্টরা চেয়েছিল অন্য সকল দল ও মতকে নিষিদ্ধ করে কেবল নিজেদের রাজত্ব কায়েম রাখতে। সেই স্বপ্নের সোভিয়েটের লৌহ শাসন তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে। যাদের তারা নিষিদ্ধ করেছিল, তারাই আজকে টিকে আছে। অতএব দল, আদর্শ বা চিন্তাকে শক্তি বা ত্রাসের মাধ্যমে নিষিদ্ধ বা দমন করা যায় না। সাহসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পরাজিত করতে হয়। যখন সেটা করা যায় না, তখনই ভয়ে বা বিপদের আশঙ্কায় নিষিদ্ধ করে নিজে বাঁচতে চায়। অতীতের ইতিহাসে এ রকমভাবে কেউ বাঁচেনি। ভবিষ্যতেও ইতিহাসের নিয়মের বাইরে গিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না। মিসরসহ সারা বিশ্বের নব্য স্বৈরাচারীরা এই সত্যটি ভুলে গেলে নিজেদের বিপর্যয় ঠেকানোর আর কোন পথ থাকবেনা। পালাবারও পথ পাওয়া যাবে না।
মুসলিম জাহানের প্রায় ৩০টি দেশের মধ্যে যে দুই-চারটি শক্তিশালী রাষ্ট্র রয়েছে তার মধ্যে মিসর অন্যতম। এই দেশটির জনসংখ্যা ৮ কোটি এবং সশস্ত্র বাহিনীর জনবল ৬ লক্ষাধিক। মিসরের সামরিক বাহিনীতে রয়েছে আধুনিক জঙ্গি বিমান ও ট্যাঙ্ক। মিসরের বিশাল সামরিক বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে শক্তিশালী করা হয় এই জন্য যে, প্রয়োজনে তারা যেন অবাঞ্ছিত রাষ্ট্র ইসরাইলকে মোকাবেলা করতে পারে। কিন্তু মিসরের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ইসরাইলের বিরুদ্ধে তার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে পারেনি। দু’টি আরব ইসরাইল যুদ্ধে মিসরীয় বাহিনী পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু মিসরীয় বাহিনী তাদের শক্তিমত্তা ঠিকই প্রদর্শন করেছে। আর সেটি তারা প্রদর্শন করেছে তাদের নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে। গত ১৪ই আগস্ট বুধবার মিসরের রাজধানী কায়রোর লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর এই হামলায় শত শত মিসরবাসী নিহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পরিসংখ্যানে মতভিন্নতা রয়েছে। সরকারী পরিসংখ্যানে মৃতের সংখ্যা বলা হয়েছে ২৩৫। পক্ষান্তরে মিসরের বেসরকারী সূত্রে এবং ইরানসহ বিদেশী সূত্রে এই সংখ্যা বলা হয়েছে ২২০০। সেনাবাহিনীর এই নৃশংস হামলায় ১০ হাজার ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে দেশী-বিদেশী সূত্রে বলা হয়েছে। মিসরের সামরিক বাহিনী ধারণা করেছিল যে, তাদের বন্দুকের নলের মুখে সমবেত লক্ষ লক্ষ জনতা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু মিসরের গণতন্ত্রকামী এবং ইসলামী জনতা সেনাবাহিনীর বুলেটকে আলিঙ্গন করেছে। কায়রোতে সেনাবাহিনীর এই গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এর ত্বরিত প্রতিক্রিয়া হয় একাধিক শহরে। আলেকজান্দ্রিয়াসহ একাধিক শহরেও এই গণহত্যার প্রতিবাদে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সরকার কার্ফ্যু জারি করে এবং সারাদেশে একমাসের জন্য জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। পরিস্থিতি এতো গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে, মুসলিম ব্রাদারহুডের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আল বারাদি সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, এই গণহত্যার দায়-দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করবেন না।
মিসরের সামরিক জান্তা এবং তাদের বিদেশী মদদদাতারা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেনি। তারা ভুলে গেছে যে, পাইকারী হারে গণহত্যা করে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যায় না। তারা একথাও ভুলে গেছে যে, এটি একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। এটি তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক বা মিসরের জামাল আবদুল নাসেরের যুগ নয়। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক শত শত মানুষের হত্যাকান্ড অবধারিতভাবে শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রভাব বিস্তার করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে মিসর একদিকে যেমন সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, তেমনি তার বর্তমান রাজনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত হলেও আমেরিকা, ইসরাইল এবং সউদী আরব, তুরস্ক ও ইরানের কাছে মিসরের রয়েছে অসাধারণ গুরুত্ব। তাই মিসরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের জন্য অতীব জরুরী। সেটি নিশ্চিত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মিসরে সমস্ত দল ও গোষ্ঠীকে এক কাতারে জমায়েত করা। বছরের পর বছর ধরে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। এই দলের অনেক নেতাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। ৮০ বছর পর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় এসেছিল। গত নির্বাচনে ব্রাদারহুডের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল প্রান্তিক। কিন্তু মিসরের সামরিক জান্তা দেশটিকে যে রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে তার ফলে ব্রাদারহুডের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের এ ব্যাপারে রয়েছে বিরাট দায়িত্ব। একথা সত্য যে, বৃহত্তম দল হওয়া সত্ত্বেও ব্রাদারহুড আজ মিসরে মজলুম বা নির্যাতিত। দেশটি যে রক্ত পিচ্ছিল পথ মাড়াচ্ছে সেখানে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে হলে ব্রাদারহুডকেও সমঝোতার মধ্যে এগুতে হবে। সেনাবাহিনীর এই গণহত্যার জবাব হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুডও পাল্টা আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর ফলে সমগ্র মিসর গৃহযুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছে। দেশটিকে বাঁচাতে তাই আজ সামরিক বাহিনীর সাথে ব্রাদারহুডকে আলোচনায় বসতে হবে। বিগত অর্ধ শতকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দুনিয়ার বুদ্ধি-পরামর্শে মুসলিম জাহানের কোনো উপকার হয়নি। তাই পশ্চিমা দুনিয়াকে বাদ দিয়েই মিসরবাসীকে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরকেই সমাধান করতে হবে। আমেরিকা সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা সেজেছে। অথচ মিসরে গণতন্ত্র উৎখাতে সেনাবাহিনী যখন সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে তখন আমেরিকা একটি কথাও বলেনি। বরং তাদের উস্কানীতেই মিসরে গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক শাসন এসেছে বলে এখন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাসমূহ খবর দিচ্ছে। তবে এই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ওআইসি বা ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন এবং আরব লীগের নির্লিপ্ততা অত্যন্ত দুঃখজনক। মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীরা একই সাথে আরব এবং মুসলমান। তাদের সমস্যায় পশ্চিমারা মোড়লী করবে, সেটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং মুসলিম উম্মাহর সদস্য এবং আরব জাহানের ভাই হিসেবে এই দুটি সংস্থা সামরিক বাহিনী এবং মুসলিম ব্রাদারহুডকে আলোচনার টেবিলে বসানোর উদ্যোগ নিতে পারে। সংঘর্ষ, রক্তপাত এবং গৃহযুদ্ধ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সেখান থেকে গণতন্ত্র ও শান্তির পথে ফেরার আর কোনো উপায় থাকবে না।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা ।ইমেইল : altaf.husain64@yahoo.com
