ads

মঙ্গলবার , ১৩ আগস্ট ২০১৩ | ৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনপ্রাপ্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
  1. ENGLISH
  2. অনিয়ম-দুর্নীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আমাদের ব্লগ
  6. ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  7. ইসলাম
  8. উন্নয়ন-অগ্রগতি
  9. এক্সক্লুসিভ
  10. কৃষি ও কৃষক
  11. ক্রাইম
  12. খেলাধুলা
  13. খেলার খবর
  14. চাকরির খবর
  15. জাতীয় সংবাদ

গানের নজরুল : কিছু কথা — মোহাম্মদ জাকীর হোসেন

শ্যামলবাংলা ডেস্ক
আগস্ট ১৩, ২০১৩ ১১:০০ অপরাহ্ণ

    Nazrul  গানের বুলবুল কবি নজরুল বাংলাদেশের সঙ্গীত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। তিনি যেন গানের দরবারে শাহানশাহ্। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সঙ্গীতে যে জোয়ার এনেছিলেন নজরুল সেই প্রবাহমান ধারাকে প্লাবনে পর্যবসিত করলেন। গানের সংখ্যা, বিষয় বৈচিত্র, সুর বৈচিত্র সর্বদিক থেকে তিনি অন্যদের অতিক্রম করে গেলেন, আর এক্ষেত্রে আজো তিনি অদ্বিতীয়। শয়নে-স্বপনে সঙ্গীতই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। ১৯৩৮ সালে জনসাহিত্য সংসদের উদ্বোধনী সভায় সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেন- ‘সাহিত্যে আমার দান কতটুকু জানা নেই, তবে এটুকু মনে আছে সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’
এই ‘কিছু’ আসলে নজরুলের বিনয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি দিয়েছেন অনেক-অপরিমেয়। বাংলা সঙ্গীতকে বহুরূপে বর্ণিল সাজে সাজিয়েছেন, ঝংকৃত করেছেন, মধুর, প্রান্ময়, রূপবতী করেছেন। অনবরত ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র মাধ্যমে বাংলা গানকে নান্দনিকতার এক অনতিক্রম্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। চিরাচরিত বাংলা গানের গতানুগতিক ধারাকে ভেঙ্গে ফেলেন নজরুল, দূর করেন একঘেঁয়েমি। পুরানো পুঁজি ভাঙ্গিয়ে খাবার লোক নন নজরুল। তাঁর জন্মই হয়েছিল যেন আরো নতুন, নতুনতর কিছু করার জন্য।
শিশুকালে লেটো দলে লেখা গান বাদ দিলে মোটামুটি ২৮ বছর বয়সে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম গান রেকর্ড হয়-‘জাতের নামে বজ্জাতি।’ তারপর থেকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে, এই সতের বছর ধরে তিনি অসংখ্য গান লিখেছেন, সুর করেছেন। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য ‘এন্তার গান লিখেছে নজরুল, ডাইনে-বাঁয়ে লিখেছে, তার সীমাসংখ্যা নেই। খাতা থেকে শাদা একটা পৃষ্ঠা ছিড়ে নিয়েছে আর চকিতে সেটা একটা গানের ফুল, গানের পাখি হয়ে উঠেছে। সে সমস্ত গান আজ কোথায়? ফুল হয়ে ঝড়ে পড়েছে উপেক্ষার ধূলোতে, পাখি হয়ে উড়ে গেছে বিস্মরণের আকাশে। কত গানের হদিস নেই, কত গান আংশিক, কত গানের লেখকত্ব অনির্ণীত।’
কোন প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রণালীবদ্ধ সঙ্গীত শিক্ষার সুযোগ নজরুলের জীবনে ছিল না একথা সকলেই জানেন। তবে আপন প্রচেষ্টা এবং অদম্য আগ্রহে তিনি ওস্তাদ জমীর উদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ কাদের বখ্শ, মঞ্জু সাহেব, দবীর খাঁ, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, মস্তান গামা, খলিফা বাদল খাঁ,  ওস্তাদ ফৈলাজ খাঁ, তাঁদের  সাহচর্যে এসেছেন, আশীর্বাদ নিয়েছেন। শিক্ষক সতীশ চন্দ্র কঞ্জিলাল এবং চাচা কাজী বজলে করিমের কাছেও তিনি সঙ্গীতে যৎসামান্য তালিম পেয়েছিলেন। তবে সঙ্গীতাঙ্গণে তাঁর যে হিমালয়সম অবদান তার প্রায় সবটাই নজরুলের স্ব-উপার্জিত।
বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারে নজরুল নিজ নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। গজল, নাত, হামদ, কাওয়ালী, ইসলামী ভক্তিগীতি, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ঝুলন-সঙ্গীত, ভাওয়াইয়া, হাসির গান, কৌতুকগীতি, কাব্যগীতি, শিশুদের জন্যে সঙ্গীত, মার্শাল সঙ্গীত এমনকি বাউল সঙ্গীত রচনা করেছেন তিনি। কিভাবে গান লিখতেন, সুরারোপ করতেন তিনি? কণ্ঠশিল্পী কাননবালা দেবী তাঁর ‘কবি প্রণাম’ এ লিখেছেন যে, কবির দিকে তিনি অবাক হয়ে চেয়ে থাকতেন। কবি তাঁকে বলতেন, ‘ডাগর চোখে দেখছ কি? আমি হলাম ঘটক, জানো? এক দেশে থাকে সুর, অন্য দেশে কথা। এই দুই দেশের বরকনেকে এক করতে হবে। কিন্তু এ দু’টির জাত আলাদা হলে চলবে না, তা’হলেই বেবনতি।’ নতুন নতুন রাগ সৃষ্টির ব্যাপারে প্রশ্ন করলে মজা করে বলতেন ‘আমি স্বপ্নে এসব রাগ পেয়েছি।’
সুর এবং রাগ সৃষ্টিতে নজরুল এক যুগস্রষ্টা মহান আবিস্কারক। স্বভাবজাত তিনি একজন কবি ছিলেন, কিন্তু সঙ্গীতে পূর্ণতালাভের জন্যে এবং কবিতা ও সঙ্গীতের সমন্বয়সাধনের জন্যে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই বলেন ‘আমার দুঃখ এই যে, লোক আমাকে কবি হিসেবে জানে, কিন্তু আমি কবিতা রচনার জন্যে বেশি পরিশ্রম করিনি। আর আমি যে শিল্পের জন্যে জীবনপাত করেছি লোকে সে সর্ম্পকে কম জ্ঞান রাখে। আর সেই শিল্প হল সঙ্গীত।’ শাস্ত্রীয় জ্ঞানার্জনে তিনি ফারসি, সংস্কৃতসহ বিভিন্ন ভাষায় লিখিত গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করেন। এগৃুলির মধ্যে রয়েছে ‘সঙ্গীত রতœাকর’, ‘রাগ বিরোধ’, ‘কলানিধি’, ‘সঙ্গীত পারিজাত’, ‘মারিফুন্নাগমাৎ’, ইত্যাদি। সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন নজরুল আহার নিদ্রা ত্যাগ করে একনাগাড়ে ২/১ দিন পর্যন্ত ধ্যানী তাপসের মত সময় কাটাতেন বলেও জানা যায়।
অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তিনি সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন। কমল দাসগুপ্ত লিখেছেন, ‘সেদিন (একদিনে) আমার খাতায় ১২ খানা শ্যামাসঙ্গীত লিখেছিলেন। প্রত্যেকটি গান অনবদ্য।’
শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের স্মুতিচারণ থেকে জানা যায়- একবার তিনি কাজী নজরুল ইসলামের বাসায় যান। তখন যোহরের ওয়াক্ত প্রায় শেষ হয়ে আসছে দেখে তিনি কবিকে একটি জায়নামাজ দেয়ার অনুরোধ জানান। কবি তার অবস্থানের পাশের রুমে জায়নামাজ বিছিয়ে আব্বাস উদ্দীনকে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। নামাজ শেষ করে আব্বাস উদ্দীন এসে দেখেন কবি ইত্যবসরে একটি ইসলামী গান লিখে শেষ করেছেন, যার প্রথম কলি ‘হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ।’ নজরুলের গানের একেকটি কলি, ছত্র, অন্তরা, বিচিত্রতায় পরিপূর্ণ। ‘ভূলি কেমনে আজো যে মনে বেদনা সনে রহিল আঁকা’, গানটির ছত্রে ছত্রে প্রতি অন্তরায় তাল, লয় ও ছন্দের তারতম্য সবিশেষ লক্ষ্যনীয়।
যাঁদের কণ্ঠে নজরুলের উজ্জ্বল সঙ্গীতগুলোকে প্রথমদিকে জনপ্রিয় করতে অবদান রেখেছে তাঁরা হলেন ইন্দুবালা দেবী, আঙ্গরবালা দেবী, কমলা ঝরিয়া, হরিমতী, কে. মল্লিক, আব্বাস উদ্দীন, জ্ঞান গোস্বামী, মৃণাল ঘোষ, গিরীন চক্রবর্তী, সন্তোষ সেনগুপ্ত, সত্য চৌধুরী, শচীন দেববর্মণ, যুথিকা রায়, দিপালী তালুকদার, সুধীরা সেনগুপ্ত, ফিরোজা বেগম প্রমুখ। গ্রামোফোন কোম্পানীর রিহার্সাল রুমে নজরুলের সহকারী ছিলেন ধীরেন দাস, চিত্ত রায়, নিতাই ঘটক।
বিশেষত রাগ সঙ্গীত সম্পর্কে নজরুলের ভক্তি ও নিষ্ঠা তুলনারহিত। তিনি নতুন রাগ রাগিনীর সৃষ্টি করেছেন পরম মমতায়। তাঁর ‘নবরাগমালিকা’, ‘হীরামনি’, সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত। বাংলা গানে সার্থক ঠুংরী রচনা তাঁর অবিনশ্বর কীর্তি। এ শ্রেণীর গানে তিনি ভৈরবী, পিলু, খাম্বাজ, কাফি, দুর্গা, মান্তু, আশাবরী, যোগিয়া, মুলতান, সিন্ধু, কালাংড়া প্রভৃতি রাগ রাগিনী ও দাদরা, কাহাররা, যৎ লাউনী, একতাল, কাওয়ালী, আদ্ধাকাওয়ালী, তেওরা প্রভৃতি বিভিন্ন তাল ব্যবহার করেছেন। নতুন কিছু রাগও তিনি সৃষ্টি করেছেন। নজরুল বলেন, ‘বেনুকা ও দোলনচাঁপা দুইটি রাগিনীই আমার সৃষ্টি।’
তাছাড়া তিনি মীনাক্ষী, আশা ভৈরবী, অরুণ, যোগিনী, সন্ধ্যামালতী, উদাস ভৈরবী, অরুণ রঞ্জনী প্রভৃতি রাগ সৃষ্টি করেছেন। নজরুল নিজে যেমন অপর গীতিকারের গানে সুর দিয়েছেন ঠিক তেমনি তাঁর কিছু কিছু গানে অন্যরা সুরারোপ করেছেন। বিশেষ করে নজরুলের গানে সুর দিয়েছেন- কমল দাশগুপ্ত, চিত্ত রায়, হিমাংশু দত্ত, ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস, জগন্ময় মিত্র, আব্বাস উদ্দীন, পাচু বসু, রঞ্জিত রায় প্রমুখ। অন্যদিকে মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ নাটকের দশটি গানের রচয়িতা হেমেন্দ্র কুমার রায়। অথচ এর মাত্র একটি গানে তিনি নিজে সুর দিয়েছেন, বাকী নয়টি গানেরই সুরকার কাজী নজরুল ইসলাম।
দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, জাগরণ ও উদ্দীপনার তাড়নায় সব কালজয়ী সঙ্গীত রচনা করে চলেন নজরুল। টলমল টলমল পদভরে/ আমরা শক্তি আমরা বল/ ওঠরে চাষী জগতবাসী/ ওরে ধ্বংস পথের যাত্রীদল/ দূর্গম গিরি কান্তার মরু/ কারার ঐ লৌহ কপাট/ শিকল পড়া/ ছিল মোদের/ জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা/ মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নজরুলের বহু বিখ্যাত গান পৌরুষ, বীরত্ব, শৌর্য ও আজাদীর সংগ্রামী প্রেরণায় পরিপূর্ণ। এসব গান যদি দেশের বাইরেও গীত হয়, যেখানে শব্দার্থ বোধগম্য নয়, তাহলেও সে দেশের লোকেরা সেটাকে মার্শাল মিউজিক বা যুদ্ধের সঙ্গীত বলে বুঝতে পারবেন।
শিশুদের জন্যে রচিত নজরুলের গানগুলো এককথায় চমৎকার। শিশুতোষ এসব গান আনন্দ দেয়, মাতিয়ে তোলে, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে। এসব অতুলনীয়, অনুপম গানের মধ্যে ভোর হল, দোর খোল/ আমি হব সকালবেলার পাখি/ ঝিঙে ফুল, ঝিঙে ফুল/ একেককে এক, বাবা কোথায় দেখ/ অ’মা তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং/ পার হয়ে কত নদী/ আমি সাগর পাড়ি দেব/ বাবুদের তালপুকুরে/ মা আমারে সাজিয়ে দে গো/ রব না চক্ষু বুজি/ ঘরের আড়াল ভেঙ্গে এবার/ আগুনের ফুলকী ছোটে/ প্রজাপতি, প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বিদেশী সুরগুলোকে নজরুল আপন গুণে অত্যন্ত সফলভাবে কাজে লাগান নিজ সৃষ্টিতে। মিশরিয় সুরে রচনা করেন ‘মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে।’, আরবী সুরে ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়’, কিউবার সুরে ‘দূর দ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি’, ইরানী সুরে ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’, মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় সুরে ‘রুমুঝুমু রুমঝুম’, কর্ণাটি সুরে ‘আমি পূরব দেশের পুরনারী/ খেজুর পাতার’। কাশ্মীরের সঙ্গীতকার আগা হাশার রচিত ‘হাম জায়েঙ্গে ওয়াঁহা খুশ দিলে দিওয়ানা যাহা হো’ গানটির সুরের আলোকে এবং ভক্ত আব্বাস উদ্দীন আহমেদের অনুরোধে মাত্র ১৫/২০ মিনিট সময়ে নজরুল রচনা করেন ঈদের সেই বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে।’ নজরুল রচিত ইসলামী সঙ্গীতের সংখ্যা কোন বিচারেই ৩০০ এর অধিক নয়, অপরদিকে হিন্দু ঐতিহ্য আশ্রিত তাঁর গানের সংখ্যা সর্ববিচারে সহস্রাধিক এবং উভয় ক্ষেত্রের গানেই তাঁর মমত্ববোধ, প্রেমভক্তি সমভাবে লক্ষণীয়।
ইসলামী গানগুলোর মধ্যে ‘আল্লাতে যার পূর্ণ ঈমান/ বক্ষে আমার কাবার ছবি/ বাজলো কিরে ভোরের সানাই/ আয় মরু পারের হাওয়া/ দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠিছে/ আল্লাহ আমার প্রভূ/ তওফিক দাও খোদা ইসলামে/ তোরা দেখে যা আমিনা/ সাহারাতে ফুটলোরে/ ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ/ মরুর ধুলি/ মোহাম্মদ মোর নয়নমণি/ আমি যদি আরব হতাম/ আমার মোহাম্মদের নামের ধেয়ান/ মোহাম্মদ নাম যতই জপি/ এই সুন্দর ফুল/ হে প্রিয় নবী/ দে যাকাত/ নূরের দরিয়া/ এ কোন মধূর শরাব দিলে?’ ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়। একইভাবে সনাতন ঐতিহ্য আশ্রিত গানের মধ্যে এল নন্দের নন্দন/ আমার হাতে কালি মুখে কালি/ বল্রে জবা বল/ ব্রজগোপী খেলে/ আমি কি সুখে লো গৃহে রব/ শ্যামা নামের লাগলো আগুন/ হে পার্থ সারথী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
নজরুলের গানে বেশকিছু খন্ড খন্ড বাণী-মাধূর্য এবং রূপকল্প শ্রোতাকে মুগ্ধ করে, বিস্ময়াভিভূত করে, যেমন-‘দেব খোঁপায় তারার ফুল কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দোল, রামধনু হতে লাল রং ছানি আলতা পরাব পায়/ একাদশীর চাঁদরে ঐ রাঙ্গা মেঘের পাশে যেন কাহার ভাঙ্গা কলস আকাশ গাঙ্গে ভাসে/ তোমার তাজমহল ফিরদৌসের একমুঠো, বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম/ ধানি রং ঘাঘরি মেঘ রং ওড়না/ নীলাম্বরী শাড়ি পড়ি নলি যমুনায় কে যায়?/ বুনো হাঁসের পাখার মত উড়– উড়– করে মন’ ইত্যাদি লক্ষণীয়।
প্রাচীন অপ্রচলিত রাগ সংযোগে বাংলা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত রচনা নজরুলের আশ্চর্য সৃষ্টি। এগুলি রাগ প্রধান সঙ্গীত থেকে ভিন্ন ধরনের এবং পুরোপুরি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতও নয়, যেমন- বাগেশ্রী, মালগুঞ্জী, নূরোচকা, নীলাম্বরী, মালকোষ, রামকেলী, মেঘমল্লার, জয়-জয়ন্তী, ভায়রো, ভৈরবী, দরবারী কানাড়া, দেশি টোরি, সিন্জুড়া, তিলক কামোদ, পিলু ইত্যাদি। সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, সঙ্গীতরসের কয়েকটি মৌলিক প্রকারভেদ যেমন- বীররস, ভক্তিরস করুণরস, শৃঙাররস প্রভৃতি সুর রাগ, শব্দচয়ন, অর্থ, উচ্চারণ প্রতিটি শব্দের আক্ষরিত ধ্বনি, ছন্দ, তাল, লয় অর্থ্যাৎ সাবলীল গতিময়তা ইত্যাদির পৃথক পৃথক নিয়ম আছে। সঙ্গীত তখনই পূর্ণতা লাভ করে যখন এ সমস্তের সমন্বয় সাধিত হয়। আর নজরুলের গানে এসব গুণাবলী পূর্ণমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়।
নজরুল রচিত মোট গানের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি চার হাজারের মত গান লিখেছিলেন বলা যায়। হাসির গানে নজরুল অনন্য। তাঁর চন্দ্রবিন্দু ও সুরসাকী সঙ্গীত গ্রন্থের কিছু অংশে হাসির গান পাওয়া যায়। নিজের হাসির গানে নজরুল এঁকেছেন আমাদের সমাজ আর রাজনীতিগত ভূলত্র“টির প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। ‘বদনা গাড় তে গলাগলি করে/ দে গরুর গা ধুইয়ে/ আমার হরিনামে রুচি/ থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়’, তাছাড়া লীগ অব নেশন্স, ডোমিনিয়ন, স্টেটাস, রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স, সাইমন কমিশন রিপোর্ট, প্রাথমিক শিক্ষা বিল প্রভৃতি গান উল্লেখ করা যায়। কৌতুকোদ্দীপক হালকা রসের গানও তিনি লিখেছেন ‘আমার খোকার মাসী/ তুই উল্টা বুঝলি রাম’ ইত্যাদি।
নজরুলের গানের সবচেয়ে সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হলো এর বৈচিত্র্য। এ বিষয়ে নজরুল পুত্র কাজী অনিরুদ্ধের ‘নজরুল গীতি’ নামক নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করা যায়, ‘নজরুলগীতির কত বৈচিত্র্য। নিষ্ঠাবান বৈষ্ণবের সাধনার ধন যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা, আপত্য øেহের মধুর অভিব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা আর গোষ্ঠলীলা, প্রেমলীলা আর শ্রী রাধিকার বিরহ কথাকে তিনি সঙ্গীতরূপ দিয়ে আগ্রহী মানুষকে তৃপ্ত করেছেন। শক্ত যিনি তিনি শ্যামা মায়ের পায়ের তলায় নিজের মনটিকে একটি রাঙ্গা জবা করে অর্পণ করতে পারেন। শ্যামা সঙ্গীতের খেয়ায় তার মন চলে যায় অনন্তলোকে। মুসলমান যিনি তিনি ঈদের বাঁকা চাঁদ প্রথম দেখার আনন্দে আত্মহারা হয়ে মোবারকবাদ জানাবার ভাষা খুঁজে পান এই নজরুল গীতির ভাণ্ডার থেকে। প্রেমিক যিনি তিনি প্রেমের বিচ্ছিন্ন স্তরে সুখ-দু:খের অনুভূতি পাবেন তাঁর গানে। প্রেমের গানের পবিত্র সুর ধারায় অবগাহনে আনন্দ পাবেন। কাজী নজরুলের দেশাত্মবোধক গান সারা বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত জনগণের অন্তরমথিত বাণী। তাঁর হাসির গান সেকালের সামাজিক অবস্থা উপলব্ধি করা যায়, যা সুতীক্ষ্ম শ্লেষে ভরা।’  দু:খের সঙ্গে বলতে হয় এ নিবন্ধ শেষ করার আগেই কাজী অনিরুদ্ধের জীবনাবসান হয়।
কাজী নজরুলের মমতাময় মনের গান বহু বর্ণিল সুর ও বাণী নিয়ে শতধারায় উৎসারিত হয়েছে। কাব্যের জগতে যেমন, তেমনি বাংলা গানের আকাশেও তিনি যেন ধূমকেতুর মত আবির্ভূত হয়েছিলেন। বনের পাখির মত তিনি গেয়ে গেছেন অবিরাম। তাঁর গানের ভাণ্ডার বিশাল আর এর বিশ্লেষণ বহুমাত্রিক। ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে সীমিত পরিসরে এর খণ্ড বিখণ্ড কিছু অবতারণা করে প্রবন্ধের শেষে এ মহান পুরুষের মর্মস্পর্শী সেই আবেদনের প্রতি বিদগ্ধ পাঠকের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করি –
‘আমায় নহে গো ভালবাস
শুধু ভালবাস মোর গান’
লেখক : কবি, আবৃত্তিকার, নজরুল গবেষক, জেলা প্রশাসক. শেরপুর।
DC JAKIR

Shamol Bangla Ads

সর্বশেষ - ব্রেকিং নিউজ

error: কপি হবে না!