হাকিম বাবুল : উত্তর বাছুর আলগা; গুটি ইউরিয়ার এক আদর্শ গ্রাম। শেরপুরের নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নে এ গ্রামের অবস্থান। এ গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা ধান সহ বিভিন্ন শাকসব্জী ও ফলমুল চাষাবাদে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করে ভাল ফলন পাচ্ছেন। এতে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। গ্রামেই এখন গুটি তৈরীর কারখানা স্থাপন হওয়ায় গুটি ইউরিয়া পাওয়া যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি ক্ষেতে সঠিকভাবে গুটি পুতার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক থাকায় গুটির ব্যবহার আরও সহজ হয়েছে। উত্তর বাছুর আলগা গ্রামটি এখন ‘গুটি ইউরিয়া আদর্শ গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কৃষক-কৃষাণীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিন বছর যাবত তারা চাষাবাদে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার শুরু করেছেন। প্রথমদিকে গুটির ব্যবহার নিয়ে তাদের মনে সংশয় থাকলেও এখন গ্রামটির শতকরা প্রায় আশি ভাগ কৃষক ধান আবাদসহ বিভিন্ন শাকসব্জী ও ফল চাষে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার করে ভাল ফলাফল পাচ্ছেন। কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, গুটি ইউরিয়ার ব্যবহারে ধানের ফলন গুড়া ইউরিয়ার চাইতে শতকরা ২০/২৫ ভাগ বেশী পাওয়া যায়। ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে, পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয় এবং ধানে চিটা কম হয়, দানা পুষ্ট হয়। গুটির ব্যবহারে সব্জীর আকার বড় হয়, দেখতে সুন্দর হয় এবং বাজারে এর দামও ভাল পাওয়া যায়। কলা চাষেও গুটির ব্যবহার বেশ লাভজনক।

উত্তর বাছুর আলগা গ্রামের কৃষক এমদাদ মিয়া (৪৮) বলেন, আইজ কয়েক বছর যাবত গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করছি। তাতে ধানের ফলন বেশী পাইতাছি, ইউরিয়া কম লাগতাছে। ধানের চিডা কম অয়, মরা হিাজা অয়না, ধানের কালার সুন্দর সুন্দর অয়, দানা পুষ্ট অয়। ওই গ্রামের আরেক কৃষক শহীদুল হক হীরা (৫৮) জানান, আমি প্রথমে ধানেতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করি। এতে দেখা যায় ছিটানো গুড়া ইউরিয়ার চাইতে ফলন বেশী পাই। তাছাড়া ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে এবং পোকামাকড়ের আক্রমনও কম হয়। যাতে আমি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হই। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি কলা আবাদে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করি এবং কলাগুলো বেশ সতেজ ও বড় হওয়ায় ভাল লাভবান হই। আমাদের এলাকার প্রায় সকল কৃষকই এখন গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করে ফসল আবাদ করছেন। কৃষাণী তামান্না বেগম (৩৫) বলেন, গুটি মাইধ্যে অনেক বেশী ফলন বেশী পাইতাছি। আমি কফির মাইধ্যে গুটি ব্যবহার করছি, কফি বড় হইছে, ওজনে বেশী অইছিল। ধানেতে ব্যবহার করছি ধান পুষ্ট হইছে, ফলন বেশী পাইছি। এই পদ্ধতিতে আমি একটা বেগুনটাল করছি। হেইন গুটি ব্যবহার কইরা খুব ভাল ফলন পাইছি। বেগুনটাল খুব সুন্দর অইছে। অনেক টাকার বেগুন বেচছি। এই গুটি দিয়া আবাদ কইরা আমি খুব লাভবান হইছি। আমার সংসার এখন খুব সুখের।
কৃষি বিভাগের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় উত্তর বাছুর আলগা গ্রামের ৩৫০ টি কৃষক পরিবারের মাঝে এখন ৩১০ টি কৃষক পরিবারই সারা বছরব্যাপী তাদের শস্য উৎপাদনে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করছেন। গুটির ব্যবহার জনপ্রিয় হওয়ায় আইএফডিসির সহায়তায় ওই গ্রামে একটি গুটি তৈরীর কারখানা স্থাপন করা হয়েছে এবং গুটি পুতার জন্য ১২ জন কৃষি শ্রমিককে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়েছে। কৃষকদের পাশাপাশি এসব শ্রমিকদের জীবনেও স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। গুটি পুতার প্রশিকষণপ্রাপ্ত শ্রমিক আব্দুল হামিদ মিয়া (২৮) জানান, আমরা আইএফডিসি থেকে গুটি পুতার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ভোর সকাল থাইক্কা দুপুর পর্যন্ত একেকজন শ্রমিক এক একর জমিতে গুটি পুততে পারি। আর এক একর জমির গুটি পুতার জন্য নেই শ’ ট্যাকা। সংসারের অন্য কাজ করার পাশাপাশি আমরা গুটি পুতার কাজ করছি। এতে আমাদের আয়-উন্নতিও বাড়ছে। অপরদিকে গুটি তৈরীর কারাখানার মালিক জিন্নাতুল ইসলাম বাদল বলেন, আমি আইএফডিসি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সহায়তায় এলাকায় গুটি তৈরীর মেশিন (ব্রিকোয়েট মেশিন) বসাই। প্রতি মৌসুমে আমি প্রায় ৮০ টন গুটি উৎপাদন করি। এতে খরচ বাদেও আমার ৬০/৬৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। এলাকায় এখন গুটির ব্যাপক চাহিদা।

কৃষি বিভাগ ও আইএফডিসির কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যেই আইএফডিসি’র পক্ষ থেকে নকলার উত্তর বাছুর আলগা গ্রামকে গুটি ইউরিয়ার আদর্শ গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গুটি ইউরিয়ার পাশপাশি এ গ্রামের কৃষকরা এখন পানিসেচে এডাব্লিউডি বা পর্যায়ক্রমে ভেজানো শুকানো প্রযুক্তিসহ কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ও ফসল চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহার করছেন। এতে তারা ফসলের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভুমিকা রাখছেন। কৃষকরাও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় তাদের আয় ও জীবনযাত্রার মান বেড়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
নকলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আশরাফ উদ্দিন বলেন, বাছুর আলগা উত্তর গ্রামটিকে আইএফডিসির পক্ষ থেকে গুটি ইউরিয়ার আদর্শ গ্রাম হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। শেরপুর জেলায় এটাই গুটি ব্যবহারের একমাত্র আদর্শ গ্রাম। যেখানে কৃষক-কৃষানীরা ধান ফসলের পাশাপাশি অন্যান্য সব্জী যেমন পেপে, বেগুন, টমেটো, আলু, কফি এমনকি কলার আবাদেও গুটি ব্যবহার করে ভাল ফলন পাচ্ছেন। সেখানে গুটি তৈরীর মেশিন থাকায় দিন দিন গুটির চাহিদাও বাড়ছে। ওই গ্রামে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশাল ভুমিকা রাখছে।
আইএফডিসি’র (আন্তর্জাতিক সার উন্নয়ন সংস্থা) ফিল্ড মনিটরিং অফিসার (এফএমও) আবুবকর সিদ্দিক বলেন, গুটি ইউরিয়ার ব্যবহারে উত্তর বাছুর আলগা গ্রামে ধানের ফলন শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব্জীতে তাদের সব্জীর কোয়ালিটি খুব ভাল হয়েছে। এতে কৃষকরা বাজারে ভাল দাম পাচ্ছেন। আদর্শ গ্রামে ধান, সব্জী ও ফলচাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার, শস্য বিন্যাস গুটি ইউরিয়া প্রদর্শনী, এডাব্লিওডি সেচ পদ্ধতির ব্যবহার, গুটি প্রয়োগে এপ্লিকেটর (গুটি পুতার যন্ত্র) ব্যবহার এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহার সম্পর্কে প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন করা হচ্ছে।
