রেজাউল করিম বকুল : মৌচাষে ভাগ্য বদলাচ্ছে আদিবাসী নারীরা। পরিবর্তিত অবস্থায় এখন তারা সুখের দিন গুণছেন। সেইসাথে ফিরে আসছে গারো পাহাড়ের হারানো ঐতিহ্য।
ক্রমাগত উজার হচ্ছে শেরপুর ও জামালপুর জেলার গারো পাহাড়ের বন জঙ্গল। ফসলি জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কীট নাশক। এতে মৌমাছির খাদ্য আর বাসস্থানের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে হারিয়ে গেছে পরিশ্রমী বন্য মৌমাছি। মাত্র দু’যুগ আগেও আদিবাসী অধ্যুষিত এ গারো পাহাড়ে ছিল মৌমাছির অভয়ারণ্য। প্রায় ঘরেই দেখা যেত মধু। কিন্তু এখন তা বিলুপ্তির পথে। মাত্র ৫/৬ বছর আগেও গারো পাহাড়ের মালাকোচা ডুমুর গাছ ও বালিজুরি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবনসহ বিভিন্নস্থানে দেখা যেত শত শত মৌচাক। বছরে ৪/৫ মাস চলতো মধু আহরণ। সে সময় মৌয়ালিদের ছিল পোয়াবারো। আজগর আলী, নিতেন মারাক, লবকোশ মারাকসহ ক’জন মৌয়ালিদের হিসাব মতে, গারো পাহাড় থেকে বছরে অন্তত এক হাজার লিটার মধু আহরণ হতো। এসব মধু স্থানীয়ভাবে চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্নস্থানে রফতানি হতো। সে সময় ছিল ফুল আর পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষ। এ জন্য গারো পাহাড়ের গ্রামগুলোতে দেখা যেত অসংখ্য মৌচাক।
এখনও গৃহবধূরা বিশ্বাস করেন, যদি বাড়ির ওপর দিয়ে মৌমাছির দল উড়ে যায় তাহলে ঢেকিতে পাড় দিতে হয়। ঢেকির শব্দে ওই বাড়িতে মৌচাক করতো মৌমাছিরা। এমনকি ভাল মন্দ বা সুখ দুঃখ বুঝেও মৌমাছি চাক করতো বলে তাদের ধারনা। মৌমাছি আর মৌচাক এখন নতুন প্রজন্মের কাছে কবির কবিতার মতোই। যা এখন বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। ভবিষ্যত প্রজন্ম শুধু দেখবে চাষাবাদের মৌমাছি।
এমনি এক সংকটময় সময়ে মৌমাছি চাষাবাদে ঝুঁকে পড়ছেন আদিবাসী নারীরা। দিন বদলের প্রচেষ্টায় এটি যেন নতুন হাতিয়ার। তাদের এ প্রচেষ্টাকে সফল করতে সহযোগিতা করছেন কারিতাসের প্রমোশনাল অব লাইভলী হোড এন্ড হিউম্যান রিসোর্স (পিএলএইচআর) প্রকল্প। আদিবাসীদের জীবনমান আর মানব সম্পদের উন্নয়নের লক্ষ্যে নেমেছেন সমন্বিত ফসলের চাষাবাদ। এর মধ্যে অল্প পুঁজি আর কম পরিশ্রমে বেশি আয় হচ্ছে মৌমাছির চাষাবাদে। এ যেন ফিরে আনছে গারো পাহাড়ে মৌমাছির বসবাসের আগের সেই ঐতিহ্য। ধর্মীয়সহ যে কোনো উৎসব আর অতিথি আপ্যায়নে চা বিস্কুটের আগে পরিবেশনে স্থান পাচ্ছে মধু। এ ছাড়াও দুর্বলতাসহ নানা রোগেও ওষুধ হিসেবে সেবন করছেন অনেকে। উৎপাদিত মধু বিক্রি করে নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন তারা। এরই মধ্যে শুধুমাত্র মৌমাছির চাষাবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন আদিবাসী নারী আইরস দালবৎসহ অনেকে। সম্প্রতি গারো পাহাড়ের মৌয়ালি, আদিবাসীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
শেরপুরে শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তে গারো পাহাড়। এখানে প্রায় অর্ধশত গ্রাম রয়েছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেষাঁ এ পাহাড়ে আদিকাল থেকে আদিবাসীদের বসবাস। গভীর অরণ্যের এ গ্রাম গুলোতে আগে মৌচাক ছিল আনাচে কানাচে। মাঘ ফাল্গুন হতে শুরু হতো মধু আহরণ। চলতো আষাঢ় শ্রাবণ মাস পর্যন্ত। বন্য প্রাণীর হামলা উপেক্ষা করে মধু আহরণ করতো মৌয়ালিরা। যে বেশি বড় বৃক্ষে বা ঝোঁপ জঁঙ্গলের গাছে ওঠে মধু আহরণ করতে পারতো তার সুখ্যাতি ছড়ে পড়তো চারিদিকে। গারো পাহাড়ের মাইনদ্দিন, বিল্লাল মিয়া, কছিম উদ্দিন, সাইদুর ও সনু সাংমাসহ অনেক মৌয়ালি জানান, এ সীমান্তে গারো পাহাড়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার। এর মধ্যে মৌয়ালি ছিল ১০/১২জন। তারা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়াত। যে বাড়িতে মৌচাক ছিল। সে বাড়ির মালিকরাই বেশি মধু পেয়েছেন। এখন আর পাহাড়ে মৌচাক নেই। তবে আগের সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চলছে নিরব বিপ্লব। গারো পাহাড়ের আদিবাসী নারীরা ফল মূল আর পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষ রোপন করছেন। এর পাশাপাশি শুরু করছেন মৌমাছির চাষাবাদ। ইতোমধ্যে আইরস দালবৎসহ অনেক আদিবাসী নারী মৌমাছির চাষ করে দেখছেন সোনালী স্বপ্ন।
শ্রীবরদীর গারো পাহাড়ের আদিবাসী গ্রাম বাবেলাকোনা। এখানে মৌমাছির চাষ করে সংসারে স্বচ্ছলতা আনছেন সার্টিন মারাকের স্ত্রী আইরস দালবৎ। তার সাফল্যের সংবাদ এখন গারো পাহাড়ের টক অবদা ভিলেজ। তিনি জানান তার সাফল্যের নেপথ্যের নানা কথা। তার এক ছেলে তিন মেয়ে। তার পরিবারে সদস্য সংখ্যা ছয়। ক’বছর আগে একেবারেই থেমে ছিল তার সংসারের চাকা। চরম দুর্দিনে ঢাকা ছিল পরিবারটি। সেই দুর্দিনের ভয়াবহ চিত্র মনে হলে এখনও চোখে জল আসে তার। তিনি জানান, তাদের ৮/৯ একর জমি ছিল। তারা পাহাড়ি এ জমিতে জুম চাষ করতো। একই জমিতে ধান আর শাকসবজিসহ সমন্বিত ফসলের চাষে উৎপাদিত ফসলে চলতো সারা বছর। কিন্তু বন বিভাগ পাহাড়ের ঝোঁপ জঁঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তুলেন একাশি ও আকাশমনিসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের নানা বৃক্ষ। অন্যদিকে ভারতের সীমান্ত থেকে আসতে থাকে বন্য হাতি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর বন্য হাতির অব্যহত হামলায় ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা। এতে চরম দুর্ভিক্ষে দিন কাটান তারা।
এমনি এক সময় তাদের পাশে দাঁড়ায় কারিতাসের আইসিডিপির পিএলএইচআর প্রকল্প। মহা দুর্যোগের মধ্যেও তারা আঁকড়ে রেখেছেন আড়াই একর জমি। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের সহায়তায় শুরু করেন সমন্বিত ফসলের চাষাবাদ। তিনি আরো জানান, তার বিয়ে হয় ১৯৮৯ সালে। তাদের বাড়ি ঘেষেঁ ছিল পাহাড়ি ঝরনা। এখান থেকে তারা মাছ সংগ্রহ করতেন। গারো পাহাড়ে ছিল অসংখ্য মৌচাক। বন্য মোরগ আর পশু পাখির ছিল অভয়ারণ্য। জুম চাষ আর পশু পাখি ও মাছ সংগ্রহ করে নিজেদের চাহিদা মেটাতো সারা বছর। কোনো কিছুরই অভাব ছিলনা তাদের। ঘুমানোর আগে ও ঘুম থেকে ওঠে তারা মধু পান করতো। আহরণ করা মধু জমিয়ে রাখতেন মাটির কলসে। আইরস দালবৎ বলেন, যখন দুঃসময়, কোনো উপায় ছিলনা, তখন কারিতাসের পিএলএইচআর প্রকল্প থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। তাছাড়া তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এমনকি তাদের সার্বিক সহযোগিতায় শুরু করি সমন্বিত ফসলের চাষাবাদ। পুকুরে মাছ চাষ, হাসঁ মুরগির খামার, মৌমাছির চাষ ও শাকসবজির চাষাবাদ করে আসছি। এর মধ্যে মৌমাছির চাষে বেশি লাভ হচ্ছে। তার স্বামী সার্টিন মারাক জানান, ২০১২ সালের মে মাসে তাদের এ প্রকল্প শুরু হয়। শুরুতে মৌমাছির বাক্স ছিল একটি। এখন তার খামারে ৫ টি মৌমাছির বাক্স রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৫ হাজার টাকা। তাদের এ থেকে দুই মাস পর পর আয় হচ্ছে ৪/৫ হাজার টাকা। তিনি বলেন, মৌমাছি চাষাবাদে তেমন পরিশ্রম নেই। অন্যান্য কাজের ফাকেঁও এটি করা যায়। তবে আয় বেশি বলে মৌচাষের পরিধি বাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, আশপাশে ফুল আর ফলের গাছ বাড়ছে। এতে মধুর উৎপাদন বাড়বে। আইরস দালবৎতের মৌচাষের সাফল্য দেখে রিনি ম্রং, আঞ্জেলা মৃসহ এলাকার অনেকে মৌচাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কারিতাসের আইসিডিপির প্রজেক্ট সুপারভাইজার হিলারি ম্রং বলেন, সমন্বিত ফসলের চাষাবাদের মধ্যে মৌচাষে তারা বেশি লাভ পাচ্ছেন। তাই এ এলাকার অনেকেই এখন মৌচাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে অভিজ্ঞ মহলের মতে, কারিতাসের আইসিডিপির পিএলএইচআর প্রকল্পের পরিধি আরও বাড়ানো হলে গারো পাহাড় হবে দেশের অন্যতম মৌচাষ এলাকা। এখানকার আদিবাসী নারীসহ শতশত মানুষ মৌচাষ করে খোঁজে পাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ। এলাকার চাহিদা মিটিয়েও রফতানি করতে পারবে এখানকার মধু- এমনটাই প্রত্যাশা করছেন স্থানীয়রা।