স্টাফ রিপোর্টার : ঐতিহাসিক সোহাগপুর গণহত্যা দিবস ২৫ জুলাই। একাত্তরের এই দিনে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নাম না জানা ৪৪ জনসহ ১৬৪ (মতান্তরে ১৮৭) নিরীহ পুরুষকে নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। তখন থেকেই ওই গ্রামের নতুন নামকরণ করা হয় ‘বিধবা পল্লী’। সময়ের ঘূর্ণাবর্তে একে একে পার হয়ে যায় অনেকটি বছর। নিজেদের চেষ্টার পাশাপাশি সরকারী ও বেসরকারীভাবে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয় ওই দরিদ্র বিধবা পল্লীর সদস্যদের। কিন্তু বেচে থাকার ন্যুনতম অবস্থা ছাড়া তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন খুব একটা হয়নি। এমনি অবস্থাতেও বয়োবৃদ্ধ বিধবারা নিরন্তর অপেক্ষায় ছিলেন তাদের স্বামী-সন্তানদের হত্যার বিচার দেখে যেতে। ইতোমধ্যে তাদের স্বামী-সন্তান হন্তারক গোষ্ঠীর প্রধান জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসির রায় হওয়ায় তাদের শুকনো চোখে ফের আনন্দাশ্র“ ফিরে আসে। কিন্তু কামারুজ্জামানের ফাসির রায় আদৌ কার্যকর হবে কিনা তা নিয়ে কিছুটা সংশয়ে আছেন তারা। ঘাতক কামারুজ্জামানের ফাসির রায় দ্রুত কার্যকর হবে এবং তা তারা শুনে যাবেন এটাই এখন তাদের শেষ প্রত্যাশা।
সোহাগপুর বিধবাপল্লীর অবস্থান শেরপুর জেলা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নে। ৭১-এর ২৫ জুলাই সোহাগপুর গ্রামে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদর কমান্ডার মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্বে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক-হায়েনার দল ও তাদের স্থানীয় দোসররা। ১৭০ অবলা নারীর উপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। ঘটনার পর সোহাগপুর গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। সেই থেকে গ্রামটি পরিচিতি পায় ‘বিধবাপল্লী’ হিসেবে। তখন থেকেই সোহাগপুরের স্বামীহারা বিধবা-বীরাঙ্গনাদের কান্নার শেষ ছিল না। আস্তে আস্তে তাদের চোখের জল একেবারেই শুকিয়ে যায়। সেই চোখগুলো পরিনত হয় নিরাক পড়া পাথরে। সময় গড়ায় সময়ের ঘূর্ণাবর্তে। বাড়তে থাকে দিন-মাস-বছর। সেইসাথে গাণিতিক বৈপরীত্যে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কমতে থাকে সোহাগপুরের বিধবা-বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা। এখন তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র ৩৪ জন। স্বামী হারানোর ব্যথা আর সম্ভ্রম হারানোর ক্ষত বুকে চেপেও এতদিন তারা অপেক্ষায় ছিলেন ঘাতক কামারুজ্জামানসহ তার দোসরদের বিচার দেখার জন্য। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর অবশেষে সোহাগপুরের গণহত্যা-ধর্ষণসহ যুদ্ধাপরাধের মামলায় তার ফাসির রায় হওয়ায় তারা আনন্দিত হয়। ঘটনার ৪২ বছর পর স্বামী খেজুর আলী আর সন্তান-স্বজনসহ পরিবারের ৮ জনকে হারানো সত্তরোর্ধ জরিতন বেওয়া সোহাগপুর গণহত্যার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার স্বামী ও পুলারে যারা মারছে মরবার আগে তাগোর নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি দেইখ্যা যাইবার জন্যই বাইচা আছি।’ আর সেদিনের সেই হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে চাইলে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া বলেন, ‘যারা আমগো বেডাইনরে মারছে, তাগোর নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির সাজা অইছে, হুইন্না আমগো কইলজাডা জুড়াইয়া গেছে। অহন আমগো বুহে চাইপ্যা রাহা স্বামী-সন্তান আর নিজেগো ইজ্জত হারানোর কষ্ট অনেকডাই কইম্যা আইছে। তবে অহন আমরা শেষ অফেক্ষা আছি কামারুজ্জামানের ফাসি দেইখ্যা যামু।’
