রফিকুল ইসলাম আধার : বৃক্ষ সংকটসহ অনুকূল আবহাওয়া আর মানুষের আন্তরিকতাবোধের অভাবে শ্যামল বাংলার বিভিন্ন প্রজাতির পাখি যখন কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে, ঠিক তখন পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার ব্যতিক্রমী দায়িত্ব কাধে নিয়েছেন শেরপুরের মুর্শিদপুর দরবার শরীফের পীরসাহেব। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আর ভক্তদের দীক্ষা প্রদানে প্রতিনিয়ত ব্যস্ততার পরও তার পক্ষে ওই অভয়াশ্রম গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে কেবল পাখি বা জীবপ্রেমের কারণেই। এতে একদিকে যেমন তার পাখিবান্ধব মানসিকতার বর্হিঃপ্রকাশ ঘটেছে, অন্যদিকে তার গড়ে তোলা অভয়াশ্রম নাম না জানা ও বিলূপ্ত প্রায় হাজার হাজার পাখ-পাখালির কলকাকলীতে মূখরিত পরিবেশ উপহার দিচ্ছে। এসব পাখির কলরবে এখন প্রতিনিয়ত মূখরিত থাকে মুর্শিদপুর দরবার শরীফ ও তার আশেপাশের পরিবেশ। ওই পরিবেশ দরবারে আসা ভক্তকুল ও দর্শনার্থীদের মনকেও মুগ্ধ করে তুলছে। এ এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ আর ব্যতিক্রমী পরিবেশÑ যা নিজের চোখে না দেখলে অনুভব করার নয়।
শেরপুর জেলা সদর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দুরে সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নে ‘মুর্শিদপুর দরবার শরিফ’ এ প্রায় ৪০ বিঘা জায়গা জুড়ে বিচিত্র প্রজাতির পশু, ফলজ ও বনজ গাছ-গাছালী এবং সেইসব গাছপালায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলা হয়েছে ওই পাখির অভয়াশ্রম। ১৯৯৩ সালে আলহাজ্ব খাজা মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা হায়দার ওরফে দোজা পীরের ওই দরবার শরিফ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রায় ২শ একর জায়গার মধ্যে প্রায় ৪০ একর জমিতে বিশাল কৃত্রিম বনভুমির তৈরী করে সেখানে দেশীয় বিভিন্ন ফল যেমন- আম, জাম, কাঠাল, কলা, পেপে, লেবু, পেয়ারা, লিচু, কামরাঙ্গা, জামরুল, ছফেদা, কাঠবাদাম, সৌদি আরবের খেজুরের বাগানসহ নানা প্রজাতির ফলজ ও বনজ বাগান গড়ে তোলা হয়। ওই খেজুর বাগানে এখন থোকা থোকা খেজুর ঝূলছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মুর্শিদপুর দরবারে রয়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির পাঁচ হাজার বৃক্ষ। আর ওইসব বৃক্ষে বাস করছে নানা প্রজাতির নাম না জানা বিলুপ্ত প্রায় অসংখ্য পাখ-পাখালি। ওইসব পাখির আবাসস্থল নিরাপদ করতে এবং আরো নতুন নতুন পাখির আবাসস্থল গড়ে তোলার জন্য দরবার শরিফের পীরসাহেব নিজ উদ্যোগে এ বছর প্রায় ৫ হাজার গাছে মাটির হাড়ি বা কলসি বেধে দিয়েছেন। ওইসব পাখির বাসা বা আবাসস্থল নিরাপদ করতে কলসির তলদেশ ছোট ছোট ছিদ্র করে দেওয়া হয়েছে, যাতে বৃষ্টিতে পানি জমে পাখির বা বাসার কোন ক্ষতি না হয়। নাম জানার মধ্যে যে সব পাখি সহজেই চেনা যায় এবং অভয়াশ্রমে চোখে পড়ে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়না, টিয়া, শালিক, চড়–ই, বাবুই, কবুতর, ঘুঘু, বউ কথা কও, দোয়েল, বুলবুলি, শ্যামা, ফিঙ্গে, কাঠ ঠুকরা ইত্যাদি।
মুর্শিদপুর দরবার শরিফের খাদেম আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল জব্বার ও আলহাজ্ব মোঃ আবুল বাশার জানান, প্রতি বছর ওই দরবার শরিফে বার্ষিক ওরশসহ ৬টি বড় অনুষ্ঠান হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২ লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম ঘটে। কিন্তু এত লোকের ভিড়েও ওই পাখিগুলোর নিরাপত্তায় কোন ব্যাঘাত ঘটেনা। এখানে পাখি ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পশু যেমন দেশী ও বিদেশী প্রজাতির গরু, দুম্বা, মেরা-ভেড়া, ছাগল, রাজহাস, চিনা মুরগি, খোরগোশ, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি। ওইসব পশু-পাখির বিচরণ আর কলকাকলী দরবারে আগত ভক্তদেরকে মুগ্ধ করে প্রতিনিয়ত। শুধু মাত্র দরবারে আসা ভক্তকুলই নয়, পাখির অভয়াশ্রমের খবর পেয়ে জেলা শহরের অনেক পাখি প্রিয় সাধারণ দর্শনার্থীরাও এখন ভীড় করছেন দরবার শরিফে।
দরবারের ভক্ত আসম নাসিম কাকন, সেলিম হায়দার ও জাহিদ রাঙা জানান, দরবারের চারপাশে গড়া বাগানের ফল মূলত অভয়াশ্রমে থাকা পাখিদের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর পর দরবারের প্রয়োজনে গাছ থেকে পাড়া হয়। তবে এমন অনেক ফল রয়েছে যা একেবারেই পাড়া হয়না। ওইসব ফল কেবল মাত্র পাখিদের জন্যই রাখা হয়। ফলে প্রতি বছর বৈশাখ মাস থেকে পাখিদের বিচরণ শুরু হয়। প্রতি বছরই বাড়ছে পাখিদের উপস্থিতি। এখানে এমন অনেক পাখি আছে, যারা স্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তুলেছে। তবে কিছু নাম না জানা ও বিরল প্রজাতির পাখি শুধু বছরে একবার এখানে এসে বংশ বিস্তার করে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে চলে যায়। আবার পরবর্তী বছর ছুটে আসে বংশ বিস্তারের জন্য। ফলে আস্তে আস্তে ওই দরবার শরিফের চারপাশ এখন পাখির অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। দরবারের অপর এক ভক্ত-খাদেম ও স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ আবুল হোসেন রাসেল জানান, ওই দরবার শরিফে হাজার হাজার পাখি আশপাশের বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে পোকা খেয়ে সাবাড় করার কারণে এলাকার শত শত একর জমিতে পোকা দমনের জন্য এখন বিষ বা কীটনাশক খুব একটা ব্যবহার করতে হয়না স্থানীয় কৃষকদের। ফলে এলাকার সাধারণ মানুষও ওইসব পাখিদের আবাসস্থলে এবং খাদ্য গ্রহনের সময় কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃৃষ্টি করে না। ১৯৯৮ সালের শেরপুর জেলার মধ্যে বৃক্ষ রোপনের উপর জাতীয় পুরস্কার পায় ওই দরবার শরিফ।
পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার নিরন্তর প্রচেষ্টক মুর্শিদপুর দরবারের পীরসাহেব আলহাজ্ব খাজা মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা হায়দার অমর বাণী ‘জীবে দয়া করে যেজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’ উচ্চারণ করে বলেন, পাখিদের তিনি সন্তানের মতোই দেখেন, ভালবাসেন সন্তানের মতই। এখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্তকুলরা আসেন। খাওয়া-দাওয়া করেন। অতিরিক্ত খাবারের অংশটা এখানের পশু-পাখির খাদ্য চাহিদা মেটালেও পাখিদের প্রাকৃতিক খাদ্য বিশেষ করে বিভিন্ন গাছের ফল গাছেই রেখে দেন। কাউকে পাড়তে দেন না। ওই ফলগুলো পাখিদের খাদ্য চাহিদা মেটায়। ফলে পাখিরাও এখানে পর্যাপ্ত খাবারের কারণে আবাসস্থল গড়ে তুলেছে। এভাবেই গড়ে উঠা আবাসস্থলে থাকা পাখিদের কলরবে এখানকার প্রকৃতি আজ ভিন্ন। এজন্য প্রতিবেশি লোকজন ও দরবারের ভক্তদের সহযোগিতাও অকপটে স্বীকার করেন তিনি।