শ্যামলবাংলা ডেস্ক : এবার একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। ১৭ জুলাই বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের জুরিবোর্ড ওই রায় ঘোষণা করেন। অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া।
সাংবাদিক সিরাজ অপহরণ-গুমসহ ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগের মধ্যে মধ্যে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ১, ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। প্রমাণিত ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড, ১ ও ৫ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং ৩ নম্বর অভিযোগে ৫ বছরের কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রমাণিত না হওয়া ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে খালাস পেয়েছেন মুজাহিদ।
অভিযোগ-১: একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার চামেলীবাগ থেকে সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন অপহৃত হন। তাকে মুজাহিদের পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭-৮ জন যুবক মিনিবাসে তুলে নেয়। আজ পর্যন্ত তার কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ-৩: একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের কোন একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে রাজাকাররা। বেলা অনুমান ১১টার দিকে ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউজে আসামি আলী আহসান মুজাহিদের সামনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে হাজির করা হয় বাবু নাথকে। তখন মুজাহিদ ওই মেজরের সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার একটি দাঁত ভেঙে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আবদুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরে রাতে রণজিৎ নাথ বাবু তার আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ওই ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান।
অভিযোগ- ৫ : ১৯৭১ সালের ৩০শে আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের আরেক নেতা মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান মুজাহিদ। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালাগাল করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। আসামি মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে ছাড়া অন্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।
অভিযোগ-৬ : একাত্তরের ২৭ মাচের্র পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরে রাজাকার, আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধনসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়নসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করেন।
অভিযোগ-৭ : একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে। শান্তি কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। মামলার বিচারিক কার্যক্রম।
বুধবার সকাল ১১টার দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় পড়া শুরু করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ২০৯ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে ৩৭ পৃষ্ঠা পড়েন বিচারকরা।
এর আগে সকাল ১০টা ৪৮ মিনিটে বিচারকরা আসন নেন এজলাসকক্ষে। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয় আসামি মুজাহিদকে। তার পরনে রয়েছে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। এই রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তাকে আনা হয় ট্রাইব্যুনালে। এরপর মুজাহিদকে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়। এরপর তাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়।
উল্লেখ্য, ৫ জুন উভয়পক্ষের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি-কোর্ট অ্যাওয়েটিং ভারডিক্ট) রাখেন ট্রাইব্যুনাল-২। মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ট্রাইবুনাল-২ রায় ঘোষণার এ দিন নির্ধারণ করেন। এরপর রায়ের জন্য মুজাহিদকে মঙ্গলবারই নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়।