স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক ডামাডোলে চাপা পড়ে গেছে স্থানীয় সমস্যার কথা। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নগরবাসী যেমন জলাবদ্ধতা, যানজটসহ নানা সমস্যার কথা ভুলে গিয়েছিল, তেমনি মেয়র প্রার্থীরাও এসব নিয়ে তেমন একটা কথা বলেননি। তবে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর নতুন মেয়রের কাছে একটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছে গাজীপুরবাসী।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের শিকার গাজীপুরকে বাসযোগ্য করে তোলাই নবনির্বাচিত মেয়র এম এ মান্নানের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গতকাল সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, সব সমস্যা-সংকট দূর করে গাজীপুরকে একটি আধুনিক নগর হিসেবে গড়ে তোলাই হবে তাঁর প্রধান কাজ।
নির্বাচনের দুই দিন পর গতকাল গাজীপুরের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের শিকার গাজীপুরে জলাবদ্ধতা, যানজট, জঞ্জালসহ সংকটের শেষ নেই। অনেক স্থানে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাও নেই। কিন্তু রাজধানীর খুব কাছে হওয়ায় বেড়ে চলছে এখানকার জমির দাম। যত্রতত্র গড়ে উঠেছে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। তাই এখনই যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরুর তাগিদ দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। অন্যথায় ভবিষ্যতে ঢাকার মতোই অসহনীয় নগরে পরিণত হবে বলে তাঁরা মনে করছেন।
গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এম এ বারী বলেন, গাজীপুর এত দিন অপরিকল্পিতভাবেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু এটি এখন সিটি করপোরেশন। এটিকে বাসযোগ্য আদর্শ নগর হিসেবে গড়ে তুলতে সবার আগে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। কোথায় শিল্প-কারখানা, কোথায় আবাসিক এলাকা আর কোথায় বাণিজ্যিক এলাকা হবে, সেটি ঠিক করা থাকবে এই মহাপরিকল্পনায়। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত এ কাজ করার জন্য তিনি নবনির্বাচিত মেয়রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সাবেক টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভা এবং কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, গাছা, পুবাইল, কাউলতিয়া ও বাসন ইউনিয়ন নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে পর্যাপ্ত না হলেও টঙ্গী ও গাজীপুরে কিছু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বাকি ছয়টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা এখনো খাল-বিল ও চাষের জমি। পুবাইলে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানির শত শত সাইনবোর্ড। গত তিন সপ্তাহ টানা গাজীপুর ঘুরে দেখা গেছে এখানে-সেখানে আবর্জনার স্তূপ। যত্রতত্র শিল্প-কারখানা। সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। যানজট যেন এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী।
রাজধানীর উত্তরার আবদুল্লাহপুরের পর তুরাগ নদ পার হলেই টঙ্গী, অর্থাৎ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের শুরু। একটু এগোলেই ফুটওভারব্রিজের দুই পাশে আবর্জনার স্তূপ। টেলিফোন শিল্প সংস্থার (টেশিস) কার্যালয় ফেলে আরেকটু এগোলেই স্টেশন রোড। সেখানে ভয়াবহ যানজট। বৃষ্টি হলেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। এখানকার প্রধান সড়কের দুই পাশের অনেকটাই রয়েছে অবৈধ দখলে।
টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুই পাশে চোখে পড়ে অসংখ্য তৈরি পোশাকের কারখানা। অনেক কারখানার তরল বর্জ্য রাস্তায়ও এসে পড়ছে। মহাসড়কের যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করা। ছয়দানা ও মালেকের বাড়ী এলাকায় সড়কের ওপরের কাঁচাবাজারটি যানজট ও মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। ভোগড়া পেরিয়ে গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তার ফুটপাতের ওপর দোকানপাট। এখানে কোনো বাসস্ট্যান্ড নেই, তার পরও সব গাড়ি এখানে যাত্রী ওঠানামা করছে।
চান্দনা চৌরাস্তা থেকে পশ্চিমে গেলে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী পর্যন্ত সিটি করপোরেশন এলাকা। কাশিমপুর, কড্ডা, বাইমাইল, রাজাবাড়ী, কাতলাখালী, বাগিয়াসহ এই এলাকায় সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে। এই এলাকার এখানে-সেখানে কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। তুরাগ নদ ও এলাকার বিলগুলো শিল্পবর্জ্যে বিবর্ণ ও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। এলাকাবাসী জানান, দূষণ ছাড়াও এখানকার ওয়ার্ডগুলোর রাস্তাঘাট চলাচলের একেবারেই অনুপযোগী।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কাউলতিয়া পর্যন্ত সিটি করপোরেশনে পড়েছে। ১৭ থেকে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড এদিকে। এই এলাকার অনেক রাস্তা এখনো কাঁচা। এখানেও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে অনেক পোশাক কারখানা। চান্দনা চৌরাস্তা থেকে পূর্বদিকে মূল শহরের দিকে যেতেই ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তার বিশাল জায়গাজুড়ে আবর্জনার স্তূপ। দক্ষিণ ছায়াবীথি, জোড়পুকুর, হারিনাল, রেল জংশনসহ শহরের আরও অনেক স্থানেরও একই অবস্থা।
গাজীপুর শহরের রাজবাড়ী এলাকায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আদালতপাড়া, পুলিশ সুপারের কার্যালয়সহ প্রশাসনিক সব প্রতিষ্ঠান। শহরের শিববাড়ী থেকে রাজবাড়ীর দিকে যেতে রেলগেট পেরোতে হবে। এই রেলগেটকে বলা হয় গাজীপুরের ভোগান্তি। সারা দিনে অর্ধশত ট্রেন যায় এই রেললাইন দিয়ে। ফলে সারাক্ষণই এখানে যানজট লেগে থাকে। পাঁচ মিনিটের রাস্তা গাড়িতে পার হতে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টাও লেগে যায়। এই যানজটের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে।
দক্ষিণ ছায়াবীথি এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা এস এম মুজিবুর রহমানের মতে, নতুন মেয়রের প্রথম কাজ হওয়া উচিত রেলগেট এলাকায় একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা। এখানে ছোট একটি ফ্লাইওভার করলেই গাজীপুর শহরের মানুষ ভয়াবহ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে।
গাজীপুরের এসব সমস্যা নিয়ে কথা হয় নবনির্বাচিত মেয়র এম এ মান্নানের সঙ্গে। প্রথম কোন কাজটি করবেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে যানজট ও বেহাল রাস্তাঘাটসহ যেসব সমস্যায় পড়ে, প্রথমে সেগুলো দূর করা হবে। এর পরই জলাবদ্ধতার সমস্যার দিকে নজর দেব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অন্যান্য পরিকল্পনা করব। চেষ্টা করব গাজীপুরকে একটি আধুনিক নগর হিসেবে গড়ে তুলতে।’