রওনক রেহানার টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস। তিনি কোনো পত্রিকায় লেখা পাঠানোর আগে ত্বকীকেই দেখাতেন। মায়ের লেখা দেখে দেওয়া, এমনকি ই-মেইল ত্বকীই করে দিত। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) ফ্যাশন ডিজাইনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন রওনক রেহানা। ছেলে তাই মায়ের জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে ছবি সংগ্রহ করে দিত, যাতে মা ভালোমতো শিখতে পারেন। মা-ও কম কিসে! ছেলেকে ডাকতেন ‘বস’। ছেলের মধ্য দিয়ে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতেন। এই ছেলে যে তাঁর জীবনের আলো। চুপচাপ শান্ত স্বভাবের হলেও মায়ের কাছেই যেন গল্পের ঝাঁপি খুলে বসত। এমন সন্তান হারিয়ে কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন ত্বকীর মা?
জানতে হাজির হলাম নারায়ণগঞ্জের পুরাতন কোর্ট রোডের ত্বকীদের বাড়িতে। গত ২৯ মার্চ শুক্রবার। একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিল বাড়িটি। তিনতলায় কলবেল চাপতেই দরজা খুলে দিল ত্বকীর ছোট ভাই সাকি। কোনো প্রশ্ন না করেও বুঝে গেল কেন এসেছি। গত কয়েক দিনে নানা রকম মানুষের আনাগোনা এ বাড়িতে। বসতে দিল বসার ঘরে। কম্পিউটার, হারমোনিয়াম, খাটের পাশে বই আর বই। বুঝতে বাকি রইল না এটি ত্বকীরও ঘর। মধ্যবিত্ত পরিবারে যা হয়। ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। একটু পরে তিনি এলেন। বুকের মধ্যে ভয়ংকর চাপা কষ্ট, তা তাঁকে দেখে সহজেই বোঝা যায়। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ত্বকী এই ঘরে থাকত? কিছু না বলে উত্তরে মাথা নাড়েন। ঘরজুড়ে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। এই নীরবতা বুঝিয়ে দিচ্ছিল সন্তান হারানোর হাহাকার।
খানিক পর বসার ঘরটিতে ঢোকেন ত্বকীর মা রওনক রেহানা। তিনি নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। এই ঘরের দেয়ালজুড়ে ত্বকীসহ ওদের পারিবারিক ছবি। আলমারি থেকে ত্বকীর নানা বয়সের ছবি বের করে আনেন। প্রতিটি ছবির পেছনের গল্পগুলো বলতে থাকেন তিনি। রওনক রেহানা বলেন, ‘ত্বকী একদম ওর বাবার মতো। কিছু হলেই ছবি তোলা চাই। সব সময় বলতাম, এত ছবি তুলে কী হবে। আজ ছবিগুলোই শুধু স্মৃতি হয়ে আছে, আমার ছেলেটি নেই।’ চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর।
১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবর জন্ম ত্বকীর। পুরো নাম তানভীর মুহাম্মদ। বাবার দেওয়া নাম ত্বকী। অর্থ আলো। রফিউর রাব্বি ও রওনক রেহানার জীবনে আলো হয়েই যেন জন্মেছিল ছেলেটি। সেকি ব্যস্ততা তাঁদের ছেলেকে ঘিরে। ‘আমার বাবার বাড়ি থেকে আমাকেসহ এক দিন বয়সের বাচ্চাকে নিয়ে তিনি চলে এলেন। কেননা, ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারবেন না। ত্বকীর জন্মের পর লালনপালনের পুরো কাজটি করেন ওর বাবাই। আমি একদম রাত জাগতে পারতাম না। ওকে আসলে বড় করেছেন ওর বাবা। আমি সহযোগিতা করেছি মাত্র। ছেলেকে হারিয়ে ওর বাবা কাউকে কিছু বলছেন না, কিন্তু আমি জানি মানুুষটার ভেতরে কী হচ্ছে। এমন ছেলেকে ছাড়া থাকা যায়, বলেন?’
ত্বকী শুধু মায়ের না, বাবারও বন্ধু ছিল। রাতে বাবা না ফেরা পর্যন্ত ত্বকী কখনো খেত না। মধ্যবিত্ত এই পরিবারটির একমাত্র বিলাসিতাও ছিল ত্বকীর জন্মদিনকে ঘিরে। আগে হোটেল পূর্বাণী থেকে ত্বকীর জন্মদিনের কেক আসত, গত কয়েক বছর ধরে কেনা হয় হোটেল রূপসী বাংলা থেকে।
বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেরা তো সাধারণত মা-বাবাকে এড়িয়ে চলে। আপনার ছেলের সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব হলো কীভাবে?
রওনক রেহানা যেন ফিরে যান পুরোনো দিনে। ‘ছেলের জন্যই হয়েছে। ছোট থেকেই আমার সব কাজে সাহায্য করত। সারা দিন পেছন পেছন হাঁটত। একটু বড় হওয়ার পর থেকে কত কিছু নিয়ে আমরা গল্প করতাম। ও তো লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল, আমি যা পারতাম না, সব ও শিখিয়ে দিত।’
প্রতিদিন বিকেলে ত্বকী, সাকি ও মা রওনক রেহানা কখনো স্কিপিং, কখনো টেনিস খেলতেন। মার্চ মাসে ত্বকী তার মুঠোফোন থেকে তিনটি কল করেছিল। যার দুটিই ছিল মাকে করা। ত্বকীর মা ভেবেই পান না তাঁর এমন নিষ্পাপ ছেলেকে কীভাবে মানুষ মারতে পারল।
অন্য সব দিনের মতো ৬ মার্চ দিনটি শুরু হয়েছিল। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র রাইজিং স্টারে প্রদায়ক হওয়ার ইচ্ছা ত্বকীর। বাড়িতে ইন্টারনেট মডেম নষ্ট। সকালে মাকে বলেছিল, আবেদনপত্রটি ই-মেইল করতে হবে। মা বলেছিলেন, বিকেলে যেয়ো। দুপুরে বিসিকের ক্লাসে যাবেন বলে একটু তাড়াহুড়া করে বেরিয়েছিলেন রওনক রেহানা। ত্বকীর সঙ্গে কোনো কথা হয়নি যাওয়ার সময়। বাবা রফিউর রাব্বির সঙ্গেই শেষ কথা হয়েছিল ত্বকীর। বাইরে যাওয়ার আগে বলেছিল, বাবা একটু বাইরে যাচ্ছি। এরপর আর ফিরে আসেনি ত্বকী।
ও লেভেলে সে মেধার স্বাক্ষর রেখেছিল। ব্যতিক্রম হয়নি এ লেভেলেও। পদার্থবিজ্ঞানে সারা দেশে ত্বকী সর্বোচ্চ নম্বর পায়। ৭ মার্চ প্রকাশিত এ লেভেল পরীক্ষার ফলাফল ত্বকী জেনে যেতে পারেনি। কোনো দিন কোচিং বা গৃহশিক্ষকের শরণাপন্ন হয়নি। মা রওনক রেহানা বলেন, ‘আমরা বলতাম, বাবা তুমি ভালোভাবে লেখাপড়া করো। তোমাকে নিজ উদ্যোগে ভালো করতে হবে। তোমাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। ভালো কাজের ফল ভালো হবেই। কিন্তু কিসের কী ভালো হলো। ওর তো জীবনটাই চলে গেল।’
৮ মার্চ সকালে ত্বকীর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল। ত্বকী নেই—এ খবর শোনার পর রওনক রেহানার মনে হয়েছিল, তাঁর চারপাশটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। শুধু ভেবেছেন, কেন তিনি বেঁচে আছেন। কতবার ছেলেকে বলেছিলেন বিদেশে খালার কাছে পড়তে যেতে। ত্বকী রাজি হয়নি। বলেছে, ‘দেশে পড়েই ভালো করব মা। তুমি এত চিন্তা কোরো না তো।’
রওনক রেহানা নিজে প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। তাই তো ত্বকী চেয়েছিল মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে। ত্বকীর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে খুব ভাবত। নারায়ণগঞ্জে গণজাগরণ মঞ্চে প্রতিদিন যেত। ত্বকী নিজে আবৃত্তি করত, রবীন্দ্রসংগীত গাইত। তবে ভালোবাসত লালন ও হাসন রাজার গান। খাতার ভাঁজে ভাঁজে থাকত কবিতা।
এখন কি ছোট ছেলেকে নিয়ে শঙ্কাবোধ করছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে দৃঢ়চিত্তে বলেন, ‘একদমই না। আমার আর কোনো কিছু হারাবার নেই। অনেকে মনে করছেন, আমার স্বামী ছেলের মৃত্যুর পর তাঁর কাজ থেকে বিরত থাকবেন। এ ধরনের চিন্তা যেন তাঁরা না করেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, দেশের কথা ভাবেন, মানুষের কথা ভাবেন বলেই এই উদার ব্যক্তিটিকে আমি বিয়ে করেছিলাম। রফিউর রাব্বির শোক তাঁর কাজ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারবে না।’
সন্তান হারানো এই মায়ের মনে অদ্ভুত একটা চাওয়া। তিনি রোজ হাত তুলে দোয়া করেন আর ভাবেন, তাঁর প্রাণের ত্বকী যদি ফিরে আসত। এই কয়েকটা দিন যদি দুঃস্বপ্ন হতো। ত্বকী ছাড়া তাঁরা যে একদম ভালো নেই।
