ads

রবিবার , ২৬ জুলাই ২০১৫ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনপ্রাপ্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
  1. ENGLISH
  2. অনিয়ম-দুর্নীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আমাদের ব্লগ
  6. ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  7. ইসলাম
  8. উন্নয়ন-অগ্রগতি
  9. এক্সক্লুসিভ
  10. কৃষি ও কৃষক
  11. ক্রাইম
  12. খেলাধুলা
  13. খেলার খবর
  14. চাকরির খবর
  15. জাতীয় সংবাদ

মানবপাচার : সিরাজগঞ্জে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এলো কয়েক যুবক

শ্যামলবাংলা ডেস্ক
জুলাই ২৬, ২০১৫ ৯:১০ অপরাহ্ণ

Sirajgonjহুমায়ুন কবির মৃধা, সিরাজগঞ্জ : সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়া পারি জমাতে চেয়েছিলো ওরা । না বুঝেই পা দিয়েছিলেন মানবপাচারকারী দালালদের ফাঁদে। সমুদ্রপথে ট্রলার বা জাহাজে নানা অত্যাচার নির্যাতন সয়ে ফিরে এসেছেন তারা। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেউ এক মাস, দুই মাস কেউ বা তিন মাস ধরে লড়াই করেছেন ট্রলার/জাহাজের দালাল ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এসব যুবক সমুদ্রে থাকা সময়ের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। তারা অনুমতি না নিয়ে নিজ হাতে পানি পান করেছিলেন হবিগঞ্জের তৃষ্ণার্ত এক যুবক। এতেই গর্জে ওঠে জাহাজে থাকা মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের দালালেরা। জাহাজের মোটা পাইপ দিয়ে অমানুষের মতো পিটিয়ে আধমরা করে সমুদ্রে ফেলে দেয় তাকে। এসময় মানুষরূপি হায়েনাগুলো উলাস করে বলে ওঠে-খা ব্যাটা পানি খা, ইচ্ছা মতো খা। সমুদ্রের স্রোতে এক সময় হারিয়ে যায় সেই যুবক। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে কান্না আর ভয়ে বুক ভার হয়ে আসছিল জাহাজে থাকা প্রায় সাড়ে তিনশ’ যুবকের। এমন রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করে ফিরে আসা মানবপাচারের শিকার রানা প্রাং (১৮)। তিনি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে। ট্রলারে ৪০ দিনের নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে রানা বলেন, আমাদের দিন কাটতো যেমন তেমন, রাত আর কাটতে চাইতো না। প্রায় সাড়ে তিনশ’ যাত্রী নিয়ে মাঝ সমুদ্রে ৪০ দিন অবস্থান করে তাদের বহনকারী ট্রলার। একজনের ওপর একজন গাদাগাদি করে থাকতে হতো। কেউ পাশ ফিরলেই আঘাত করা হতো লাঠি কিংবা জাহাজের বেল্ট দিয়ে। দালালচক্রের কাছে থাকা ছুরি, রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে হত্যার ভয় দেখানো হতো প্রতিনিয়ত। ওদের ভাষা বুঝতে পারতাম না, এজন্য আমাদের প্যান্টের বেল্ট খুলে বেদম মারপিট করা হতো। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। এ অবস্থায় ওরা রাইফেলের ফাঁকা গুলি ছুড়লো। মৃত্যুভয়ে আবার ফিরে এলাম ট্রলারে। ফিরে আসার পর আমার ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। মোটা পাইপ দিয়ে বেদম পেটানোর পর ওই দিনের খাবারও বন্ধ করে দেয় তারা। একই গ্রামের রোজগার আলী প্রাং এর ছেলে আব্দুল আলীম বলেন, ট্রলারে বা জাহাজে খাবার বলতে সকাল ৮টায় অর্ধেক কাপ পানি, ১০টায় ১০০ গ্রাম ভাতের সঙ্গে একটি শুকনো মরিচ ও বিকেলে এক কাপ পানি এবং রাতে ১০০ গ্রাম ভাতের সঙ্গে একটি শুকনো মরিচ। মাঝে মধ্যে তেল মশলাবিহীন সিদ্ধ করা শুটকি মাছ খেতে দিত যা কেউই খেতে পারতো না। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটতো আমাদের। কল্যাণপুর গ্রামের সারোয়ারের ছেলে শামীম ও নুরুল ইসলামের ছেলে আমিরুল ইসলাম বলেন, ৪০ দিনের মধ্যে একদিনও গোসল করার সুযোগ পাইনি। শরীর দিয়ে দুর্গন্ধ বের হতো। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খামার পাইকোশা গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে রিপন বলেন, যাত্রীদের গুঞ্জন থামাতে মাঝে মধ্যেই ফাঁকা গুলি করতো ক্যাপ্টেন। একদিন দুপুরের দিকে জাহাজের এক সঙ্গীর সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলছিলাম। হঠাৎ ক্যাপ্টেনের একটি গুলি এসে লাগলো আমার ওই সঙ্গীর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ওই যুবকের মৃতদেহটি সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অন্য জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া একই গ্রামের নুরনবী ও মনিরুল বলেন, দালালদের হাত বদলের মাধ্যমে তাদের জাহাজ মালয়েশিয়ার সীমানায় পৌঁছার পর আর কেউ রিসিভ করে না। ফলে জাহাজ শুধু স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। এভাবে জাহাজেই কাটে ১৫ দিন। এ অবস্থায় ইন্দোনেশিয়ার সীমান্তে পৌঁছার পর জাহাজের পেছনে থাকা স্পিডবোটে করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায় দালালেরা। প্রায় সাত থেকে আটশ’ যাত্রী নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় সাতদিন আটকে থাকা জাহাজটিতে কোনো খাবার ছিল না। অনাহারে সাতদিন থাকার পর বাঙালিদের সঙ্গে মায়ানমারের রোহিঙ্গা যুবকদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় আমাদেরসহ দু’পরে কয়েকশ’ যাত্রীকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। অসহায় আমরা সমুদ্রে ভাসতে থাকি। ওই রাতেই ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা আমাদের ভাসতে দেখে সে দেশের নৌÑবাহিনীকে খবর দেয়। পরে নৌÑবাহিনী এসে আমাদের উদ্ধার করে জেলহাজতে পাঠায়। ট্রলার থেকে ফিরে আসা এসব যুবক আরো বলেন, দালাল চক্রের মধ্যে দু’একজন বাঙালি ছাড়া বেশিরভাগই ছিল মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের। এদের ভাষা বোঝা যেতো না। আমরা ভাবতাম মৃত্যু হয়তো সন্নিকটে। মনে হতো, হয় ট্রলারে থেকে অর্ধাহারেÑঅনাহারে মরতে হবে, নয়তো দালাল বা নৌÑবাহিনীর গুলি খেয়ে মরতে হবে। ট্রলারে তোলার আগেই প্রত্যেকের বাড়িতে ফোন দিয়ে বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে দালাল চক্র। বেলকুচির সগুনা এলাকার জামাল, রুবেল, বাদশা, সাগর ও আব্দুলাহ বলেন,গত ১৯ ফেব্র“য়ারি মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে তাদের চট্টগ্রাম নিয়ে যান ছোট সগুনা গ্রামের দালাল মজিদ আকন্দ। চট্টগ্রাম পৌঁছানোর পর মজিদ দালাল সেখানাকার অন্য এক দালালের হাতে তুলে দেন তাদের। ওই রাতে মোট ৫০ জনকে ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। ট্রলারে করে তারা মায়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডের সীমানায় পৌঁছান। থাইল্যান্ডের সীমানায় চারদিন অবস্থান করার পর সে দেশের দালালরা মালয়েশিয়াগামী অপর একটি ট্রলারে তুলে দেয় তাদের। ট্রলারটি মালয়েশিয়া সীমানার ৫০০ গজ আগেই থামানো হয়। পরে সাঁতার কেটে মালয়েশিয়ার তীরে পৌঁছুলে টহলরত পুলিশের হাতে আটক হন তারা। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ মাস মালয়েশিয়ার জেলে থাকার পর গত ৭ জুলাই তারা দেশে ফেরেন। জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত সিরাজগঞ্জের ১৭ জন যুবক ফিরে এসেছেন বলে জানা গেছে। এরা হলেনÑবেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে রানা (১৭), রোজগার প্রামাণিকের ছেলে আব্দুল আলীম (১৮), শুকুর আলীর ছেলে ইমরান (২৫), জমারত আলীর ছেলে ইদ্রিস আলী (২২), মগরব আলীর ছেলে ইসমাইল (২৫), একই উপজেলার কল্যাণপুর গ্রামের নুরুল আকন্দের ছেলে আমিরুল (২০), সরোয়ার হোসেনের ছেলে শামীম হোসেন (১৬), রাজাপুর গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে আরিফুল (১৮), ছোট সগুনা গ্রামের শেতল প্রামাণিকের ছেলে জামাল (১৮), মৃত ইসমাইল হোসেনের ছেলে রুবেল (৩৮), হোসেন আলীর ছেলে বাদশা (১৭), সুলতান প্রামাণিকের ছেলে সাগর (১৮), তৈয়ব আলী তালেবের ছেলে আব্দুলাহ (২০), সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের খামার পাইকোশা গ্রামের নুর হোসেনের ছেলে মনিরুল ইসলাম (২০), মৃত সাইফুল ইসলামের ছেলে নুরনবী (১৮),লোকমান হোসেনের ছেলে শাহ আলম (২৫) ও আব্দুর রহমানের ছেলে মো. রিপন (২০)। এছাড়া আরো ৪৭ যুবক দেশে ফিরেছেন বলে জানিয়েছে বেলকুচি থানা পুলিশ। । এদিকে, মানবপাচারকারী দালালচক্রের দু’একজন ধরা পড়লেও অসংখ্য দালাল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, ভুক্তভোগীদের প থেকে কোনো মামলা বা অভিযোগ না করায় এসব দালালকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট ফর ডিজঅ্যাডভান্টেজড পিপলের (ডিডিপি) নির্বাহী পরিচালক কাজী সোহেল রানা বলেন, পাচার হওয়া অল্প কয়েকজন ফিরে এসেছেন। আরো কয়েকজনকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। তবে এখনো সিরাজগঞ্জের প্রায় দুই শতাধিক যুবক নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবী করেন তিনি । বেসরকারি সংস্থা পরিবর্তনের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক রাজু জানান, মানবপাচারে তিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ইউএস ডিপার্টমেন্টাল স্টেটের অর্থায়নে রিফিল ইন্টারন্যাশনাল ঢাকার সহযোগিতায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে তাড়াশ উপজেলায় ফিরে আসা ৪০ যুবককে স্বাবলম্বী করার ল্েয আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বেলকুচি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনিসুর রহমান জানান সিরাজগঞ্জের নিখোঁজ যুবকদের মধ্যে ৪৭ জনকে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মায়ানমারের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরই মধ্যে বেলকুচি উপজেলার ১৩ যুবক ফিরে এসেছেন। পর্যায়ক্রমে বাকিদেরও দেশে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানান তিনি। ওয়ার্ড পর্যায়ে মানব পাচারের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে বলেও জানান বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল হাসান। সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, মানবপাচারের ঘটনায় জেলার মোট ১৮টি মামলায় ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া যেসব এলাকায় মানবপাচারের ঘটনা ঘটেছে, সেসব এলাকায় জরিপের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, মানবপাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বেসরকারি কিছু সংস্থাও এনিয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি। এদিকে জেলার বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের লাল মিয়া, রোজগার প্রামাণিক সহ একাধিক অভিভাবক অর্থলোভী পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দাবি করেন ।

error: কপি হবে না!