ads

সোমবার , ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনপ্রাপ্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
  1. ENGLISH
  2. অনিয়ম-দুর্নীতি
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আমাদের ব্লগ
  6. ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  7. ইসলাম
  8. উন্নয়ন-অগ্রগতি
  9. এক্সক্লুসিভ
  10. কৃষি ও কৃষক
  11. ক্রাইম
  12. খেলাধুলা
  13. খেলার খবর
  14. চাকরির খবর
  15. জাতীয় সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি

শ্যামলবাংলা ডেস্ক
ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭ ৬:১৮ অপরাহ্ণ

তালাত মাহমুদ

কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রের অশুভ আন্তর্জাতিক রাজনীতির বলয়ে আর বিদেশী শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর ষ্ট্রিম-রোলারে নিষ্পেষিত হয়ে পৃথিবীর বুক থেকে অনেক সমৃদ্ধ ভাষাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ল্যাটিন বা হিব্রু ভাষাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আবার এমনও অনেক ভাষা প্রাচীনকাল থেকে আজোবধি টিকে আছে-যার কোন লেখ্যরূপ নেই। অথচ সে সব ভাষায় মানুষ আজও কথা বলে। যেমন গারো আদিবাসীদের ভাষা ‘আচিক’। তাছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মানুষ মাতৃভাষায় কথা বললেও নিজস্ব কোন বর্ণমালা না থাকায় তারা ইংরেজি বর্ণমালার উপর নির্ভরশীল। মাতৃভাষার দাবীতে খুব কম জাতিকেই অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে ও আত্মাহুতি দিতে দেখা গেছে। যে কারণে ভাষা সংস্কৃতির ইতিহাসে তার নজির খুব একটা খোঁজে পাওয়া যায় না।
তবে এক হাজার ২শ মাইলের ব্যবধানে দুটি আলাদা ভূ-খণ্ড নিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট, সেই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ‘বাংলা’ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্য ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর মাঝে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেশ; অশিক্ষা-কুশিক্ষা আর ভূখা-নাঙ্গা মানুষের দেশ তথা দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। তাদের মুখের ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয় কিভাবে ? আর তাই তারা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের প্রতি চর অবজ্ঞা প্রদর্শন ও শোষণের যাঁতাকলে গোটা বাঙালী জাতিকে পঙ্গু করে রাখতে নীল-নকশার জাল বিস্তার করে সর্বত্র। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র অবাংলাভাষীদের পুনর্বাসন ও আধিপত্যই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সচিবালয়, রেডিও-টিভি, রেলওয়ে, পোষ্টাল, প্রশাসন, ব্যাংক, বীমা, সকল ক্ষেত্রেই তাদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। আধিপত্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা স্থাপন ও মালিকানার ক্ষেত্রেও। আমদানী-রপ্তানীর লাইসেন্স তো অবাংলাভাষীদের একচেটিয়াই ছিল। এসব কারণে এদেশের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মাঝে দারুণ হতাশা আর অপমানবোধ কাজ করছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি সেই দারুণ হতাশা আর অপমান বোধের জবাব দিয়েছিল পশ্চিমা শাসক ও শোসকগোষ্ঠীকে। যার চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে ১৯৭১-এর সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে। মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ফলে আজ মহান শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’র মর্যাদা লাভ করেছে। যে পাকিস্তান বাংলা ভাষাকে তাচ্ছিল্য জ্ঞান করেছিল। বিশ্বের সকল দেশের মতো সেই পাকিস্তানও প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি যথাযোগ্য মর্যদার সাথে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ (শহীদ দিবস) পালন করে আসছে। একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কি হতে পারে।
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ কিভাবে অর্জিত হয়েছে তার প্রকৃত তথ্য আমাদের অনেকেরই জানা নেই। দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের কুমিল্লার কৃতি সন্তান রফিকুল ইসলাম ও চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান আবদুস সালাম ইঞ্জিনিয়ার বাংলাভাষার জন্য আত্মত্যাগের এই দিনটি অবিস্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদ্যাপনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরা দু’জনই কানাডার ভ্যাংকুবারে বসবাস করেন। ভ্যাংকুবারে রফিকুল ইসলামের পারিবারিক ব্যবসা রয়েছে। আর আব্দুস সালাম ক্যানাডায় ‘বৃটিশ-কলম্বিয়া ফেরি কর্পোরেশনে’ ফাষ্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ রফিক আর সালাম নয়, তাদেরই যোগ্য উত্তরসূরী রফিকুল ইসলাম আর আবদুল সালাম এদেরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় ১৮৮টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এর সিদ্ধান্তটি অনুমোদিত হয়।
১৯৯৮ সালের কথা। এ বছর ৯ জানুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে রফিকুল ইসলাম একটি চিঠি লিখেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বে অনেক ভাষা বিকশিত হওয়ার সুযোগ না পাওয়ার কারণে ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাতৃভাষার গুরুত্ব মানবজীবনে অন্যতম প্রধান বিষয়। এটি তার কৃষ্টি, সভ্যতা ও ইতিহাসের ধারক। যথাযথ পরিচর্যার অভাবে একবিংশ শতাব্দীতে আরো অনেক ভাষা বিলোপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই ভাষাগুলো রক্ষা করা একান্ত অপরিহার্য। এজন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী একটি নির্দিষ্ট দিনকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা যায় কিনা তা বিবেচনার অনুরোধ করা হয়। চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালীর মাতৃভাষা ‘বাংলা’র উপর আঘাত এসেছিল, ধ্বংস করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল বাংলাভাষাকে। বাঙালী জাতির অমর সন্তানেরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জীবন দিয়ে তাদের মাতৃভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল। এই আত্মহুতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি নিদটিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা যায় কিনা তা বিবেচনার জন্যও সবিনয় অনুরোধ করছি।
২০ জানুয়ারি মহাসচিবের অফিস থেকে চিফ ইনফর্মেশন অফিসার হাসান ফেরদৌস এক পত্রে রফিককে তার চিঠির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলেন, জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী এই সংস্থা কোন ব্যক্তির আবেদন বিবেচনায় নিতে পারে না। যে কোন প্রস্তাব আসতে হবে জাতিসংঘের এক বা একাধিক সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে। তিনি জানালেন, কোন সদস্য রাষ্ট্রকে বলুন, আপনার প্রস্তাবটি উত্থাপন করার জন্য। জাতিসংঘ মহাসচিবের দফতর থেকে উপরোক্ত জবাব পেয়ে মিঃ রফিক এক ধরণের হতাশায় পড়েন। কারণ কোন রাষ্ট্রের উদ্যোগে প্রস্তাবটি উত্থাপন করানো সহজ বিষয় নয়। তবু তিনি হাল ছাড়লেন না। আবদুস সালামের সঙ্গে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন। অন্যান্য ভাষাভাষী ১০ জন মানুষের সমন্বয়ে গঠন করলেন ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’। গ্র“পের বাংলাভাষী সদস্য দু’জন, এতে আরও ছিলেন ইংরেজীভাষী দু’জন, ফিলিপিন্সভাষী দু’জন, হিন্দীভাষী একজন, জার্মানভাষী একজন, চায়নার ক্যান্টনিজভাষী একজন ও ভারত-পাকিস্তানের কিছু কিছু এলাকার জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ‘কাচ্ছি’তে কথা বলেন এরকম একজন। এরা হলেন বাংলাদেশের রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম, ফিলিপিন্সের আলবার্ট ডিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবাল, যুক্তরাজ্যের (ইংল্যান্ড) জেমস মার্টিন ও সুসান হোডিংস, চৈনিক কেলভিস চাও, জার্মানীর রেনাটে মারটেনস এবং ভারতীয় নাজনীন ইসলাম ও করুণা যোশীর। রফিকুল ইসলাম গ্রুপের পক্ষ থেকে আবার জাতিসংঘের মহাসচিবকে চিঠি লিখলেন একই বিষয়ে। আর এই চিঠির একটি কপি জাতিসংঘে নিযুক্ত কানাডার অ্যামবাসাডার ডেভিড ফাওলারকে দিয়ে তাকে অনুরোধ জানান, তিনি যেন প্রস্তাবটি জাতিসংঘে উত্থাপন করেন। অ্যামবাসাডার বিষয়টি অনুমোদনের জন্য তা পাঠালেন কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে মিঃ রফিকও যোগাযোগ করতে থাকেন। এভাবে কেটে যায় ৮/৯ মাস। শেষে তারা আবার যোগাযোগ করলেন জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয়ের চিফ ইনফরমেসন অফিসার হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে। তিনি খুব কার্যকর পরামর্শ দিলেন। বললেন, এরকম বিষয় বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের উপযুক্ত ফোরাম হচ্ছে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো। হাসান ফেরদৌস সেখানে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে ইউনেস্কোর ল্যাঙ্গুয়েজ ডিভিশনের ডিরেক্টর জোসেফ পদ-এর ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর দিলেন রফিকুল ইসলামকে। মিঃ রফিক তার সাথে কথা বললেন। তিনি রফিককে তার বক্তব্য প্রস্তাব আকারে ইউনেস্কোর সদর দফতরে কর্মরত আনা মারিয়া মাইলোকের কাছে পাঠাতে বলেন। প্রস্তাবটি পেয়ে আনা খুব উৎসাহ প্রকাশ করেন। তার তরফ থেকে পরে পাঁচটি দেশের নাম দিয়ে এসব দেশকে এই প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপনের অনুরোধ জানানোর জন্য তাদেরকে বলা হলো। দেশ পাঁচটি হচ্ছে- কানাডা, ভারত, ফিনল্যাণ্ড, বাংলাদেশ ও হাঙ্গেরী। পাঁচটি দেশেরই ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কোতে চিঠি দিলেন তারা। এটা ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝির ঘটনা। হাঙ্গেরীর নিকট থেকে প্রথম সাড়া এলো ১৯৯৯ সালের ১৬ আগষ্ট। চিঠিতে হাঙ্গেরী সরকার ইউনেস্কোকে জানালেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এরপর তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রফিক উদ্দিন আহমেদ জানান, এ ধরনের চিঠি তারা এখনো পাননি। সেটির আরেকটি কপি তার কাছে পাঠাতে বললে মিঃ রফিক ফ্যাক্সে তা পাঠিয়ে দেন। শিক্ষামন্ত্রী এস.এইচ.কে সাদেক বিষয়টি জানতে পেরে খুব উৎসাহিত হন। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি এ প্রসঙ্গে জানালে প্রধানমন্ত্রী বললেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবেনা। ইউনেস্কোতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্যও তিনি নির্দেশ দেন।
এদিকে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর জেনারেল এসেম্বলির আসন্ন অধিবেশনে উত্থাপন করতে হলে ১৯৯৯-এর ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে তা এসে পৌছানো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হতে বেশ দেরী হচ্ছিল। আর এগিয়ে আসছিল ১০ সেপ্টেম্বরের ডেটলাইন। রফিকুল ইসলামের মিশন খুব উৎকণ্ঠায় পড়ে যায়। তবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউস্কোর মহাসচিব, শিক্ষা মন্ত্রাণালয়ের সচিব কাজী রকিবউদ্দিন আহম্মদ, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের ডিরেক্টর মশিউর রহমান ও ইউনেস্কোর বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশনের প্রফেসর কফিলউদ্দিন আহমদ সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে দ্রুত পাঠানোর জন্য উৎসাহব্যঞ্জক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১০ সেপ্টেম্বর ডেটলাইনের আগের দিন অর্থাৎ ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সদর দফতরে পৌছায়। নিয়ম অনুযায়ী সেটি যায় টেকনিক্যাল কমিটিতে। সেখানে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, ইউনেস্কো মহাসচিবের সিনিয়র এডভাইজার যুক্তরাষ্ট্রের তোজাম্মেল হক (টনি হক), প্রফেসর কফিলউদ্দিন ও প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর ইকতিয়ার চৌধুরী। মাঝে শিক্ষামন্ত্রীও প্যারিসে গিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার পক্ষে ভূমিকা রাখেন। ইউনেস্কোতে প্রস্তাবটি যাতে অনুমোদিত হয় সে জন্য প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। রফিকুল ইসলামের মিশনকে খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য অংশ নিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে শুরু করেন তারা। তাদের নিষ্ঠার কারণে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে আরো ২৯টি দেশ মিঃ রফিক মিশনের প্রস্তাবটির সহ-প্রস্তাবক হতে সম্মত হয়। এদের মধ্যে পাকিস্তানও ছিল। ইউনেস্কোর জেনারেল এসেম্বলিতে ১৬ নভেম্বর’ ৯৯-এ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ প্রস্তাবটি ওঠার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত তা ওঠে পরদিন ১৭ নভেম্বর। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি সেখানে অনুমোদিত হয়। ১৮৮টি সদস্য দেশের মধ্যে কেউ প্রস্তাবটির বিরোধীতা করেনি। সহ-প্রস্তাবক দেশগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, বেনিন, শ্রীলংকা, মিশর, রাশিয়া, বাহামা, ডোমিনকান প্রজাতন্ত্র, বেলারুশ, ফিলিপিন্স, কোতে দ্যা আইভরি, ভারত, হন্ডুরাস, যুক্তরাজ্য (ইংল্যান্ড), জার্মানি, গাম্বিয়া, পাপুয়া, নিউগিনি, কমোরো দ্বীপপুঞ্জ, পাকিস্তান, ইরান, লিথুয়ানিয়, ইতালি, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, স্লোভাকিয়া, প্যারাগুয়ে ইত্যাদি।
ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় ১৮৮টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’র সিদ্ধান্তটি অনুমোদিত হবার পর অধিবেশনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয় এই বলে যে, ৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ রফিক নন, তারই উত্তরসুরী একই নামের রফিকুল ইসলাম। শুধু রফিকুল ইসলাম নন, বাংলাভাষার জন্য আত্মত্যাগের ওই দিনটিকে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য আরেক নিবেদিত প্রাণ ব্যাক্তির নামও আব্দুস সালাম। ৫২-এর ভাষা শহীদের তালিকাতে ওই নামটিও রয়েছে।
২০০০ সালের ৪ জানুয়ারি ইউনেস্কো মহাসচিব কোইচিরো মাতসুয়ারা যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রথম ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের আহ্বান জানিয়ে সদস্য দেশসমূহের কাছে চিঠি পাঠান। চিঠিতে বলা হয়, শিল্প, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা যেতে পারে।
নতুন শতাব্দীতে পৃথিবী এক ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে উঠছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির অবাধ বিকাশের পাশাপাশি গ্লোবাল ভিলেজ গড়ে উঠার প্রবণতা লক্ষণীয়। এ অবস্থায় যেমন দাবি উঠেছে ভিসামুক্ত বিশ্ব-ব্যবস্থা গড়ে তোলার, তেমনি অবাধ বিশ্ব শ্রমবাজার গড়ে তোলারও দাবি উঠেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপিত হওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন এক বিস্ময়কর ঘটনা। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর একটি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ’। আর এ দেশের প্রায় ১৪ কোটি মানুষের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা। (পশ্চিম বঙ্গসহ গোটা বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি বাঙ্গালী পৃথিবীর সকল দেশেই বসবাস করে।) যদিও বাংলাভাষা বিশ্বের অন্যান্য ভাষা তালিকায় অষ্টম স্থানে রয়েছে। তথাপি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা বিশ্বব্যাপী আজ সমাদৃত এবং সম্ভ্রান্ত ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে- তা অবশ্যই আমাদের গৌরবের বিষয়।
বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আমরা ৩৫ কোটি মানুষ যে ভাষায় কথা বিল, যে ভাষায় লিখন লিখি, যে ভাষায় হৃদয়-মন-প্রাণ জুড়াই, সেই প্রিয় মাতৃভাষার নাম ‘বাংলা’। ভাষা আন্দোলনে অর্জিত ফসল ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’র মর্যাদা লাভ করেছে। মহান মে দিবসের মত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বের সকল দেশেই ভাব-গম্ভীরতার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। আজ গর্বিত এ জাতি বিশ্ব করেছে জয় —। তাইতো রক্তিম সালাম জানাই শহীদ সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিক ও অগনিত নাম না জানা ভাষা সৈনিকদের। কবির ভাষায় বলতে চাই, গান গেয়ে যাই প্রাণের সুরে স্বাধীন সোনার দেশে/ এক ফাগুনের গল্প শোনাই হাজার ফাগুন মাসে।

Shamol Bangla Ads

লেখক: কবি সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

error: কপি হবে না!